Tuesday, April 16, 2024
No menu items!
Homeইসলামের স্তরনামাযঝগড়া নয় দলিল দেখুন তারাবীহ আট রাকাআত নাকি বিশ রাকাআত।

ঝগড়া নয় দলিল দেখুন তারাবীহ আট রাকাআত নাকি বিশ রাকাআত।

তারাবীহ নামাজ অত্যান্ত ফজিলতপূর্ণ নামাজ। রমজান মাসে এশার নামাজের পর জামাতবদ্ব ভাবে তা, পড়া হয়।
তারাবীহ নামাজ সুন্নতে মুআক্কাদাহ। রাসুলুল্লাহ সাঃ রমজানের রোজা ও তারাবীহ কে গোনাহ মাফের মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আবু হুরায়রার সুত্রে, রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন যে,

سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لِرَمَضَانَ مَنْ قَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ


আমি রাসুলুল্লাহ সাঃ কে রমজান সম্পর্কে বলতে শুনেছি যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে, সাওয়াবের আশায় রাত্রি জাগরণ করে আল্লাহ তা’লা তার পুর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেন।
{[বুখারী শরীফ بَابُ فَضْلِ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ হাদীস নং-২০০৮]}


আজকের প্রবন্ধে “তারাবীহ আট রাকাআত না বিশ রাকাআত” এই বিষয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করার আশা রাখি।
আমরা যারা কোরআন এবং হাদিসের সঠিক তাহকীক ও বিশ্লেষণ, সুন্নতে সাহাবা ও হক্কানি আলেমদের পথ ও মতকে অনুসরণ করি তাদের মধ্যে “তারাবীহ আট রাকাআত না বিশ রাকাআত” এ নিয়ে কোনো বিরুধ নাই।

তবে আমাদের মাঝে একশ্রেণির কিছু মানুষ আছে যারা “তারাবীহ আট রাকাআত” প্রমাণের চেষ্টা চালায় এবং জনমনে একধরনের সংশয় সৃষ্টি করে, যার কারণে মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
তখন মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় যে, আসলে তারাবীহ আট রাকাআত নাকি বিশ রাকাআত?

চলুন আমরা এ নিয়ে কিছু আলোচনা করি।

তারাবীহ এর সুচনা।
তারাবীহ এর নামাজ রাসুলুল্লাহ সাঃ এর যামানাতেই শুরু হয়েছে। বুখারী শরীফের একটি হাদিসে হযরত আয়েশা সিদ্দকা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ এক রাতে মসজিদে গমন করে নামাজ ( তারাবীহ) পড়লেন এবং সাহাবিরাও রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইমামতিতে জামাতে শরীক হলেন। সকালে এ বিষয় নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম আলোচনা করলেন। পরবর্তি রাত এর থেকে আরো অধিক সংখ্যাক সাহাবায়ে কেরাম জমায়েত হলো। তখন রাসূলে পাক (সা.) নামায আদায় করলেন, উপস্থিত সাহাবীগণও তাঁর সাথে নামায পড়লেন। এ দিনও সকাল হলে তারা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। ফলে তৃতীয় রাতে মুসল্লির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেল। ঐ রাতে রাসূল (সা.) নামায আদায় করলেন, তার সাথে সাহাবায়ে কিরামও নামায পড়লেন। চতুর্থ রাতে মুসল্লির সংখ্যা মসজিদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী হয়ে গেল। কিন্তু রাসূল (সা.) ফজরের নামাযের আগে মসজিদে আসলেন না।


ফজর নামায শেষ করে সাহাবায়ে কেরামগণের দিকে ফিরলেন, আল্লাহপাকের একত্ববাদ ও আপন রিসালাতের সাক্ষ্য দিলেন, আর সাহাবায়ে কেরামগণকে বললেন যে, তোমাদের অবস্থা আমার কাছে গোপন ছিলনা। তারাবীহ নামাজ ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আমি তোমাদের নিকট আসিনি। আর যদি তোমাদের উপর তারাবীহ ফরয হয়ে যেত তাহলে তোমরা তা, আদায় করতে সক্ষম হতেনা।
(বুখারী, বাব- باب فضل من قام رمضان হাদীস নং ২০১২)

উক্ত হাদিস থেকে বুঝতে পারলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ তার জীবনে মাত্র তিন রাত জামাতের সাথে তারাবীহ নামাজ আদায় করেছেন। আর বাকী জীবনে কোনোদিন রাসুলুল্লাহ সাঃ কে তারাবীহ নামাজ জামাতে পড়তে দেখা যায়নি। কারণ রাসুলুল্লাহ সাঃ যদি সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে জামাতে তারাবীহ আদায় করতেন, তাহলে তা, উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যেত, এ আশঙ্কায় তিনি জীবনে কোনোদিন তারাবীহ নামাজ জামাতে আদায় করেননি।

সাহাবায়ে কেরামগণের যুগঃ
হযরত আবু বকর রাঃ এর খেলাফতকালের পুরা সময় এবং ওমরে ফারুক রাঃ এর খেলাফতকালের প্রথম দিকে তারাবীহ এর বিষয়টি এমনই ছিল অর্থাৎ প্রত্যেকে একাকী তারাবীহ আদায় করতেন অথবা ছোট ছোট জামাতে তারাবীহ আদায় করতেন।
একদা ওমর রাঃ এর খেলাফতকালে তিনি মসজিদে গিয়ে দেখেন মানুষ ছোট ছোট জামাতে তারাবীহ নামাজ আদায় করেছেন, তখন তিনি কা’ব রাঃ এর ইমামতিতে বিশ রাকাআত তারবীহ এর ব্যবস্থ করে দিলেন।


এ সম্পর্কে বুখারী শরীফে আছে, ইবনে শিহাব যুহুরী উরওয়া ইবনুয যুবায়ের থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা রামাজানের রাতে আমি ওমর (রা.)-এর সাথে মসজিদে গেলাম। তখন মানুষেরা পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত ছিল। কোন ব্যক্তি নিজে নামায আদায় করছিলেন এবং তার সাথে একটি দল নামায পড়ছিল। তখন ওমর (রা.) বললেন, আমি মনে করি এ সকল লোককে একজন ইমামের অধীনে একত্রিত করতে পারলে ভাল হবে। অতঃপর তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তাদেরকে উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর অধীনে (ইমামতিতে) একত্রিত করে দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, অন্য একদিন আমি আবার ওমর (রা.)-এর সাথে বের হলাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সাথে নামায আদায় করছিলেন। তা দেখে ওমর (রা.) বললেন, نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ অর্থাৎ এটা কতই না সুন্দর আবিস্কার।

(বুখারী, বাব- باب فضل من قام رمضان হাদীস নং ২০১০)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,


كان النبي صلى الله عليه و سلم يصلي في شهر رمضان في غير جماعة بعشرين ركعة والوتر


-নবী করীম (সা.) রামজান মাসে একাকী বিশ রাকাআত তারাবীহ ও বিতর আদায় করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ : ২/২২২)

হযরত ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা (র.) বলেন, সাইব ইবনে ইয়াযীদ (রা.) বলেছেন,


كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ فِى شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً – قَالَ – وَكَانُوا يَقْرَءُونَ بِالْمِئِينِ ، وَكَانُوا يَتَوَكَّئُونَ عَلَى عُصِيِّهِمْ فِى عَهْدِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ مِنْ شِدَّةِ الْقِيَامِ.


-তাঁরা (সাহাবা ও তাবিঈন) ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যামানায় রামাজান মাসে বিশ রাকাআত নামায (তারাবীহ) পড়তেন। তিনি আরো বলেন, তারা নামাযে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সূরাসমূহ পড়তেন এবং ওসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে দীর্ঘ নামাযের কারণে তারা (কেউ কেউ) তাদের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকী : ২/৪৯৬)


বিখ্যাত তাবিঈ আবূ আবদুর রহমান আস সুলামী (রা.) বলেন,


أَنَّ عَلِيا رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ دَعَا الْقُرَّاءَ فِى رَمَضَانَ ، فَأَمَرَ مِنْهُمْ رَجُلاً يُصَلِّى بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً. قَالَ : وَكَانَ عَلِىٌّ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ يُوتِرُ بِهِمْ.
হযরত আলী (রা.) (তাঁর খিলাফতকালে) রামজানে কারীগণকে ডাকতেন এবং তাদের একজনকে আদেশ করেন তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত নামায পড়েন। আর আলী (রা.) তাদেরকে নিয়ে বিতর পড়তেন। (সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী : ২/৪৯৬)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, বিশ রাকাআত তারবীহ শুধু রাসুলেরই সুন্নত নয় বরং খুলাফায়ে রাশেদিন এবং সমস্ত সাহাবায়ে কেরামের সুন্নত। এ ব্যাপারে অর্থাৎ বিশ রাকাআত তারবীহ এর ব্যাপারে কোনো সাহাবিই ওমরের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেননি। যদি ওমরের এই সিদ্ধান্তটি ভুল হতো তাহলে সাহাবায়ে কেরামের বিরোধিতার মুখে ওমর টিকে থাকতে পারতেন না। আর ওমরের মত ব্যাক্তিত্ব এ বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেননা। ওমরের সম্পর্কে তো রাসুলুল্লাহ সাঃ ই বলেছেন যে আমার পরে যদি আল্লাহপাক কাউকে নবি বানাতেন তাহলে সেই ব্যাক্তিই হতো ওমর। আর ওমরের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে আল্লাহ তা’লা কোরআনের অনেক জায়গায় ওহি নাজিল করেছেন। আরও একটি হাদিসের প্রতি যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখবো, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন যে,


من يعش منكم بعدى فسيرى اختلافا كثيرا ، فعليكم بسنتى وسنة الخلفاء المهديين الراشدين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ


-তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তোমরা অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরবে। তোমরা তা আঁকড়ে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখবে।
(সুনানে আবি দাউদ, বাব باب فِى لُزُومِ السُّنَّةِ হাদীস নং ৪৬০৯)
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম বিশ রাকাআত তারবীহ এর ব্যাপারে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম একমত।

ইমামদের মতামতঃ
যেখানে মুহাজির ও আনসারদের বিশাল একটি দল বিশ রাকাআত তারবীহ এর ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন, সেখানে মাজহাবের ইমামদের তো ভিন্ন মতের কোনো অবকাশ নেই। ইমাম আবু হানিফা রঃ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রঃ ও ইমাম শাফেয়ী রঃ বিশ রাকাআতের ব্যাপারে একমত। বিশ রাকাআতের কম কেউ বলেননি, তবে ইমাম মালেকের এক বর্ণনায় তারাবীহ বিতরসহ ৩৯রাকাত, অন্য আরেকটি বর্ণনায় ৪১রাকাত বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মালেকের বর্ণনা জমহুরের অনুরূপ অর্থাৎ তারাবীহ বিশ রাকাআত।


সাহাবাদের পরে তাবেইন, তাবে তাবেইন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন,সলফে সালেহীন এবং আজ পর্যন্ত যত হক্কানি আলেম অতিবাহিত হয়েছে, কেউ তারাবীহ বিশ রাকাআত নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করে নাই।

বিশ রাকাআত তারাবীহ বিদআত নয়


সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে তাবিঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ অন্যান্য উলামায়ে কিরামের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব যে, তারা সকলেই তারাবীহর নামাযকে রাসূলে পাক (সা.)-এর সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। আর বিশ রাকাআত তারাবীহ জামাআতে আদায় করা খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত, ইজমায়ে সাহাবা ও ইজমায়ে উম্মাহ হিসেবে গণ্য করেছেন। যদি তারাবীহর নামায সুন্নাত না হতো কিংবা বিশ রাকাআত আদায় করা বিদআত হতো তা হলে সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কিরাম এর উপর আমল করতেন না।

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা ও ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মসজিদে নববীতে হিজরী ১৪ সন থেকে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর ইমামতিতে জামাআতে তারাবীহ পড়া শুরু হয়। এ সময় বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়া হতো। ঐ জামাআতের মুক্তাদি ছিলেন রাসূলে পাক (সা.)-এর আদর্শে গড়া মুহাজির, আনসার ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রা.)। যারা কোনো দিন কোনো মিথ্যার সাথে আপস করেননি। যদি বিশ রাকাআত তারাবীহ বিদআত হতো তাহলে তারা এর প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করতেন। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কোন প্রতিবাদ করেন নি। বরং সকলে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে এ জামাআতে শামিল হতেন। সূতরাং তারাবীহর নামায আট রাকাআত সুন্নাত বলা এবং বিশ রাকাআতকে বিদআত বলা সুন্নাতে খুলাফা, ইজমায়ে সাহাবা ও ইজমায়ে উম্মাহর বিরোধিতার শামিল। বরং দলীল-প্রমাণের আলোকে বলতে হবে, যারা তারাবীহর নামায আট রাকাআত বলছেন তারা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

আট রাকাআতের দলীল ও কিছু কথা

পৃথিবীর ইতিহাসে ১২৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরবাদ থেকে একজন লা-মাযহাবী আলেম ২০ রাকাত তারাবীহকে বিদআত ও ৮ রাকাতকে সুন্নাত বলে ফতোয়া জারী করেন। ওলামাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই ফতোয়া অকার্যকর হয়ে গেলে তার এক বছর পর তাদের আরেকজন মাও. মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে উক্ত ফতোয়ার পুনরাবৃত্তি করেন। তার এ ফতোয়ার বিরুদ্ধে অন্যান্য আলেমদের পাশাপাশি লা-মাযহাবীদের বিখ্যাত আলেম মাও. গোলাম রাসূল ‘রিসালাতুত তারাবীহ’ (رسالة التراويح) নামক গ্রন্থ লিখে ফতোয়াটির দাঁতভাঙ্গা জবাবের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ গ্রন্থটি ১২৯০ হি. তে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলেম মাও. মুবারকপুরী, হাফেজ আব্দুল্লাহ প্রমুখ উক্ত ফতোয়াটিকে পূনরায় প্রচার ও প্রসার করতে গেলে লোকদের মধ্যে তারাবীহর রাকাতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। এদের প্রচারিত ফতোয়ার দলিল ভিত্তিক জবাব দিয়ে সব চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করেছেন ওলামায়ে দেওবন্দের অভিভাবকগণ। যথাক্রমে- আল্লামা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, আল্লামা কাসেম নানুতুবীসহ আরো অনেকে। এ বিষয়ে সর্বশেষ কলম ধরেন ভারতের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী র.।
কিন্তু চক্রান্তকারীরা থেমে নেই, স্বয়ং আরবের মাটিতেও কিছু আলেম এ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। যেখানে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র হারামাইন শরীফাইনে ১৪ শত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ২০ রাকাত তারাবীহ চলে আসছে। সে পবিত্র ভূমিতে সম্ভবত সর্বপ্রথম তারাবীহ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির জন্যে আট রাকাতের ফতোয়া জারি করেন ‘শেখ নসীব রেফায়ী’। তারাবীহ ৮ রাকাত প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। কিন্তু ওলামায়ে আরবের প্রতিবাদের মুখে সে ফতোয়াটিও টিকেনি। তাই উক্ত ফতোয়ার পক্ষে সমর্থনসহ জোরালো ভূমিকা রাখেন আরবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসীরুদ্দিন আলবানী র.। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত ফতোয়া ও তার সমর্থনকারী আলবানী সাহেবদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে আরব জাহানের কয়েক জন আলেম “আল ইসাবা ফিল ইনতেসার লিল খুলাফা-য়ির রাশিদীন ওয়াস সাহাবা” (الإصابة فى الانتصار للخلفاء الراشدين و الصحابة) নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব রচনা করেন। যেখানে উক্ত ফতোয়ার সকল দিক আলোচনা পূর্বক দলিল ভিত্তিক খণ্ডন করে ২০ রাকাত তারাবীহ সুন্নাত হওয়ার দালীলিক প্রমাণ পেশ করা হয় । এই কিতাবের ৬১নং পৃষ্ঠায় তারা লিখেছেন :


(ولم يشذ أحدهم عنها غير هذه الشرذمة القليلة التى ظهرت فى زماننا كاالشيخ ناصر و إخوانه.)
অর্থাৎ আমাদের যামানায় আত্মপ্রকাশ কারী নাসীরুদ্দিন আলবানী ও তার অনুসারীদের ক্ষুদ্র একটি দল ছাড়া আর কেউ অনুরূপ ফতোয়া দিয়ে (তারাবীহ ৮ রাকাত) উম্মত থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেন নি। অর্থাৎ এর পূর্বে কেউ ৮ রাকাতের মত ব্যক্ত করেননি; বরং সকল আলেম ফকীহ ২০রাকাতের উপর একমত ছিলেন। এরপর ১৩৭৭ ইং সালে আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেব আল ইসাবা কিতাবটির জবাবে تسديد الإصابة)) ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি বই রচনা করেন। এ বইতে তিনি ইনসাফ ভিত্তিক দলিল পেশ না করে উসূলে হাদীস, উসূলে ফিকাহ, রিজাল শাস্ত্র এবং জরাহ্ তা’দীল সম্পর্কিত সর্ব স্বীকৃত মূলনীতির ব্যাপারে স¤পূর্ণ অপরিপক্কতা ও দৈন্যতার আশ্রয় নিয়ে ২০ রাকাত তারাবীহর বিপক্ষে এবং আট রাকাতের পক্ষে যেভাবে কলম ধরেছেন তা তার মতো হাদীস বিশারদের পক্ষে কল্পনা করাও মুশকিল। এমন পক্ষপাতপুষ্ট হয়েও তিনি ইসলামের প্রায় সাড়ে বার শত বছরের ইতিহাস থেকে সাহাবা, তাবেয়ী ও সালাফে সালেহীনের ৮ রাকাত তারাবীহ পড়ার উপর একটি প্রমাণও পেশ করতে পারেননি। তেমনিভাবে এ দীর্ঘ ইতিহাসে একটি মসজিদও দেখাতে পারেননি যেখানে ৮ রাকাত তারাবীহ পড়া হতো বা হয়েছিল। তবে তিনি ওই পুস্তিকায় হযরত ইমাম মালেক র. এর দিকে ৮ রাকাতের বিষয়টি সম্পৃক্ত করে বসেন। অথচ মালেকী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্থ (المدونة) ‘আল মুদাওয়ানা’ কিতাবটি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যেতো যে, তিনি বিতরসহ ৩৯ রাকাতের তারাবীহ পড়তেন এবং তৎকালিন মদীনার গভর্নর তারাবীহর রাকাত সংখ্যা কমাতে চাইলে ইমাম মালেক তার অনুমতি প্রদান করেননি বরং নিষেধ করেছেন। (আল মুদাওয়ানা : ১/২০৮-১০)


আমার ধারণা, তিনি ইমাম মালেকের দিকে কথাটি সম্বোধন করার সময় জানতেন যে কথাটি গবেষণার কষ্টিপাথরে মোটেও টিকবেনা; কিন্তু নিজের পক্ষপাতিত্ব রক্ষার জন্য গায়ের জোরেই কথাটি চালিয়ে দিলেন। আর দলিল স্বরূপ ‘জুরী’ নামক এক শাফেঈ লোকের বরাত দিয়ে এ ভিত্তিহীন কথাটি উল্লেখ করলেন। যার সূত্রের ধারাবহিকতা ও কোন পরিচিতি নেই। বরং লোকটি মাজহুল (مجهول) এবং সনদ মুনকাতি’ (منقطع) যা অন্তত আলবানী সাহেব থেকে কল্পনা করা যায় না।
মোট কথা: ৮ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহ এর নামায নব আবিষ্কৃত সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেয়ী যুগ এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত কোন মুহাদ্দিস ও ফকীহ থেকে প্রমাণিত নয় যে আট রাকাতই যথেষ্ঠ, বিশ রাকাত বিদআত। বরং বর্তমান শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী যিনি আরব জাহানের শীর্ষ আলেম ও শাইখদেরও উস্তাদ তিনি ‘রাকাআতুত তারাবীহ’ (ركعات التراويح) নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন যে, ভারতবর্ষে ১২৮০ হি. এবং আরবের নসীব রেফায়ির পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বারশ বছরের ইতিহাসে আট রাকাত তারাবীহর উপর একটি প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেনা। তিনি তার কিতাবে প্রত্যেক শতাব্দীর উম্মার সম্মিলিত ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা (الأعمال المتوارثة) দেখিয়েছেন যে সব যুগে তারাবীহ বিশ রাকাতই ছিল। বিশ রাকাতকে বিদআত বা আপত্তি করার মতবাদ কোনো শতাব্দীতে ছিলনা। কিতাবটি প্রকাশ হয়েছে প্রায় অর্ধ শতবছর হয়ে গেলেও এ চ্যালেঞ্জের জবাব স্বয়ং আলবানীও দিতে পারেননি। আলবানী সাহেব তার বইতে যা কিছু লিখেছেন তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন সৌদি আরবের সুপ্রসিদ্ধ গবেষক শাইখ ইসমাঈল আন্সারী। তিনি বড় মূল্যবান একটি কিতাব রচনা করেন। যার নামই তার পরিচয়।


تصحيح أحاديث صلاة التراويح عشرين ركعة و الردعلى الألبانى فى تضعيفه


এ কিতাবে আলবানী সাহেব বিশ রাকাতের হাদীসকে অমূলকভাবে কলমের জোরে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা চালিয়েছেন তার দলিল ভিত্তিক জবার দিয়ে দৃঢ়ভাবে হাদীস সহীহ বলে প্রমাণ করেছেন। উপরন্তু আমার সরাসরি উস্তাদ মসজিদে নববীর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মাদীনার শরয়ী আদালতের কাজী শায়খ আতিয়্যা সালেম التراويح أكثر من ألف عام নামে একটি গ্রন্থ লিখে প্রমাণ করেছেন যে, হারামাইন শরীফাইনের ইতিহাসে কখনো বিশরাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়নি।


অন্য একজন বিখ্যাত আলেম আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আলী সাবুনীও এবিষয়ে التراويح عشرون ركعة নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব গ্রন্থের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন যে, উম্মতের সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা হতে প্রমাণিত বিশ রাকাত তারাবীহই সুন্নাত। এর উপরই সকলের “আমলে মোতাওয়ারাছাহ” প্রতিষ্ঠিত। আট রাকাতের বিষয়টি সাড়ে বারশত বৎসর পরে ভারতে উদ্ভব হয়। অতপর রেফায়ী ও আলবানীদের মাধ্যমে আরবেও এর প্রকাশ ও প্রচার ঘটে ।
লা-মাযহাবী বন্ধুরা ভেবে দেখুন! আপনারা কার অনুসরণে আজ মুসলিম উম্মার মাঝে এ নিয়ে ফিৎনা সৃষ্টি করছেন। উম্মতের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা কার উকালতি ?

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments