সম্মেলিত মুনাজাতের শর’ঈ বিধান
সংক্ষিপ্ত জওয়াব
নামাযের পর বা ফরজ নামাযের জামা‘আতের পর কোন প্রকার বাড়াবাড়ি ব্যতিরেকে আমাদের দেশে যে মুনাজাত প্রচলিত আছে, তা মুস্তাহাব আমল; বিদ‘আত নয়। কারণ-বিদ‘আত বলা হয় ঐ আমলকে, শরী‘আতে যার কোন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ উক্ত “মুনাজাত” বহু নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াত দ্বারা সুপ্রমাণিত। এ ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল ও নির্দেশ বিদ্যমান। তাই যারা মুনাজাতকে একেবারেই অস্বীকার করে, তারাও ভুলের মধ্যে রয়েছে।আবার যারা ইমাম-মুক্তাদীর সম্মিলিত মুনাজাতকে সর্বাবস্থায় বিদ‘আত বলে, তাদের দাবীও ভিত্তিহীন এবং মুনাজাতকে যারা জরুরী মনে করে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে এবং কেউ না করলে তাকে কটাক্ষ করে, গালী দেয় তারাও ভুলের মধ্যে আছে।
অবতরণিকা
নামাযের পরের মুনাজাতকে সর্ব প্রথম যিনি ভিত্তিহীন ও বিদ‘আত বলে দাবী তুলেছিলেন, তিনি হলেন আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ.। পরের তদীয় ছাত্র আল্লামা হাফিয ইবনুল কাইয়্যুম রহ. তাঁর অনুসরণ করেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ও হাফিয ইবনুল কাইয়্যুম দাবী করেন যে, নামাযের পর মুনাজাত করার কোন প্রমাণ কুরআন ও হাদীসে নেই। যে সব রিওয়ায়াতে নামাযের পর দু‘আ করার কথা আছে, এর অর্থ-হচ্ছে-সালাম ফিরানোর পূর্বের দু‘আয়ে মাছুরা।তাদের এ দাবীর খণ্ডনে বুখারী শরীফের সুপ্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাদাতা, জগৎবরেণ্য মুহাদ্দিস, হাফিয ইবনে হাযার আসকালানী রহ. বলেন, ‘ইবনুল কাইয়্যুম প্রমুখগণের দাবী সঠিক নয়। কারণ-বহু সহীহ হাদীসে সালামের পর দু‘আ করার স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়। সুতরাং ঐসব হাদীসে যে নামাযের শেষে দু‘আ করার কথা আছে, তার অর্থ সালাম ফিরানোর পরে দু‘আ ও মুনাজাত। দেখুনঃ ফাতহুল বারী, ২:৩৩৫/ফাতহুল মুলহিম, ২:১৬ পৃঃ
(۱) یترجح تقدیم الذکر الماثورۃ بتقییدہ فی الأخبار الصحیحۃ بدبر الصلاۃ وزعم بعض الحنابلۃ أن المراد بدبر الصلاۃ ما قبل السلام وتعقب بحدیث ذہب أہل الدثور فإن فیہ یسبحون دبر کل صلاۃ وہوبعد السلام جزما۰
(کتاب الأذان، فتح الباري : ۲/۴۲۶)
(۲) عن عایشۃ رضي اللہ عنہا قالت : کان النبي صلی اللہ علیہ وسلم إذا سلم لم یقعد إلا مقدار مایقول اللہم أنت السلام، ومنک السلام، تبارکت ذا الجلال والإکرام۰
لم یقعد إلامقدار ما یقول الخ : تمسک بہذا الحدیث من زعم أن الدعاء بعد الصلاۃ لا یشرع۰
الجواب : إن المراد بالنفي المذکور نفي استمرارہ جالسا علی ہیئتہ قبل السلام إلا بقدر أن یقول ما ذکر، فقد ثبت أنہ کان إذا صلی أقبل علی أصحابہ فیحمل ما ورد من الدعاء بعد الصلاۃ علی أنہ کان یقولہ بعد أن یقبل بوجہہ علی أصحابہ۰ قال ابن القیم فی الہدي النبوي : وأما الدعاء بعد السلام من الصلاۃ مستقبل القبلۃ سواء الإمام والمنفرد والمأموم فلم یکن ذلک من ہدي النبي صلی اللہ علیہ وسلم أصلا۰ ولا روی عنہ بإسناد صحیح ولاحسن۰۰۰
قال الحافظ : وما ادعاہ من النفي مطلقا مردود فقد ثبت عن معاذ بن جبل أن النبي صلی اللہ علیہ وسلم قال لہ : یا معاذ! إني واللہ لأ حبک فلا تدفع دبر کل صلاۃ أن تقول : اللہم أعني علی ذکرک وشکرک وحسن عبادتک ۰۰۰۰
قیل المراد بدبر کل صلاۃ قرب اخرہا وہو التشہد۰ قلنا قدورد الأمر بالذکر دبر کل صلاۃ، والمراد بہ بعد السلام إجماعا، فکذا ہذا۰
(فتح الباري : ۲/۱۷۵)
এমনিভাবে ইবনুল কাইয়্যুম ও তাঁর উস্তাদের উক্ত অমূলক দাবীর প্রতিবাদ করে আল্লামা যাফর আহমদ উসমানী রহ. ‘ই’লাউস সুনান’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন- “ইবনুল কাইয়্যুম প্রমুখগণ ফরজ নামাযের পরের দু‘আকে অস্বীকার করে তৎসম্পর্কিত হাদীস সমূহকে সালাম ফিরানোর পূর্বের দু‘আয়ে মাছুরা বলে বুঝাতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের এ ব্যাখ্যা ঠিক নয়। কারণ-অনেক সুস্পষ্ট হাদীস তাদের এ ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে বিদ্যমান। সুতরাং স্পষ্ট হাদীস বিরোধী এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।” (সুনান, ৩:১৫৯)
عن أبي أمامۃ رضی اللہ عنہ قال : قیل أي الدعاء أسمع؟ قال : جوف اللیل الأخیر ودبر الصلوات المکتوبات ۰۰۰
قلت : فیہ إثبات الدعاء بعد الصلاۃ۰ فاندحض بہ ما أوردہ ابن القیم الدعاء بعد السلام من الصلاۃ مستقبل القبلۃ أو المآمومین، فلم یکن ہدیہ صلی اللہ علیہ وسلم أصلا، ولا روي عنہ بإسناد صحیح ولاحسن۰ قلت : قد ثبت ذلک عنہ صلی اللہ علیہ وسلم قولا وفعلا۰
فہذا حدیث أبي أمامۃ فیہ إرشاد الأمۃ بالدعاء بعد الصلوات المکتوبات۰
وأما تأویلہ بأن المراد من دبر الصلوت ما قبل السلام کما زعمہ ابن القیم فباطل۰
قال الحافظ في الفتح : زعم بعض الحنابلۃ أن المراد بدبر الصلاۃ ما قبل السلام وتعقب بحدیث ذہب أہل الدثور فإن فیہ یسبحون دبر کل صلاۃ وہو بعد السلام جزما، فکذلک ما شابہہ۰ (اعلاء السنن : ۳/۱۵۹
(۰۰۰ یفہم منہ أنہ کان یرفع یدیہ إذا فرغ من صلاتہ، فثبت دعاۂ بعد السلام من الصلاۃ رافعا یدیہ۰ (إعلاء السنن : ۳/۱۶۱)
যারা নামাযের পরের মুনাজাতকে একেবারেই অস্বীকার করেন, তাদের জবাবে উল্লেখিত উদ্ধৃতিদ্বয় যথেষ্ট।
আর যারা বলেন, নামাযের পর একাকী মুনাজাত করা যায়; কিন্তু ইমাম ও মুক্তাদীগণের জন্য সম্মিলিত মুনাজাত করা বিদ‘আত; তাদের এ দাবীর স্বপক্ষে যেহেতু কোন মজবুত দলীল বিদ্যমান নেই, অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস বা ফাতাওয়ার কিতাব থেকে তারা এমন একটি দলীলও পেশ করতে পারেন নাই, যার মধ্যে সম্মিলিত মুনাজাতকে নাজায়িয বা বিদ‘আত বলে তার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তাই তাদের এ দাবীও গ্রহণীয় নয়।
‘নামাযের পর মুনাজাত প্রসঙ্গে হাদীসসমূহ ব্যাপকতা সম্পন্ন। এ হাদীস সমূহে মুনাজাতের কোন ক্ষেত্র-বিশেষের উল্লেখ নেই। অতএব, হাদীস সমূহের ব্যাপকতার ভিত্তিতে নামাযের পর সর্বক্ষেত্রের মুনাজাতই মুস্তাহাব বলে বিবেচিত হবে। মূল ভিত্তি সহীহ হাদীসে বিদ্যমান থাকার পর বিদ’আতের তো কোন প্রশ্নই উঠে না। (ফাইযুল বারী: ২/৪৩১)
رفع الیدین بعد الصلوت للدعاء قل ثبوتہ فعلا وکثر فضلہ قولا، فلا یکون بدعۃ أصلا، فمن ظن أن الفضل فیما ثبت عملہ صلی اللہ علیہ وسلم بہ فقط فقد حاد عن طریق الصواب، وبنی أصلا فاسدا۰
قد أخذت مأخذ الأذکار ولیس في الأذکار رفع الأیدي۰۰ إذا لم نفز بالأذکار فینبغي لنا أن لا نحرم من الأدعیۃ ونرفع لہما الأیدي لثبوتہ عنہ عقیب النافلۃ وإن لم یثبت بعد المکتوبۃ، فإذا ثبت دنسہ لم تکن بدعۃ أصلا مع ورود القولیۃ فی فضلہ۰ (فیض الباري : ۲/۴۳۱)
اعلم أن الأدعیۃ بہذہ الہیءۃ الکتابیۃ لم تثبت عن النبي صلی اللہ علیہ وسلم ولم تثبت عنہ رفع الأیدي دبر الصلوات في الدعوات إلا أقل قلیل، ومع ذلک وردت فیہ ترغیبات قولیۃ والأمر في مثلہ أن لا یٰحکم بالبدعۃ، فہذہ الأدعیۃ في زماننا لیست بسنۃ بمعنی ثبو تہا عن النبي صلی اللہ علیہ وسلم ولیست بدعۃ بمعنی عدم أصلہا فی الدین۰
(فیض الباري : ۲/۱۶۷)
হাদীসে সম্মিলিত মুনাজাতের গুরুত্বের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। ফিকহের কিতাব সমূহেও ইমাম-মুক্তাদীর সম্মিলিত প্রচলিত মুনাজাতকে মুস্তাহাব বলা হয়েছে। অসংখ্য হাদীস বিশারদগণের রায়ও সম্মিলিত মুনাজাতের স্বপক্ষে স্পষ্ট বিদ্যমান। এমতাবস্থায় প্রচলিত এ মুনাজাতকে বিদ‘আত বলা হঠকারিতা বৈ কি? নিম্নে মুনাজাতের স্বপক্ষে আল্লাহ তাআলার নির্দেশাবলী, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস সমূহ, ফিকহের কিতাব সমূহের বর্ণনা এবং হাদীস বিশারদগণের রায় সংক্ষিপ্ত দলীল সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপন করা হল ।
মুনাজাতের স্বপক্ষে কুরআন ও হাদীসের দলীলসমূহ
নামাযের পর মুনাজাত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার নির্দেশঃ
اُدْعُوْنِىْ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِيْنَ يَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِىْ سَيَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِيْنَ
১.আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত (অর্থাৎ আমার কাছে দু‘আ করা) থেকে বিমুখ হয় বা মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা অবশ্যই লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সুরা মুমিন : ৬০, তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৭ : ১৫৩)
عن الضحاک فإذا فرغت قال من الصلاۃ المکتوبۃ، وإلی ربک فارغب، قال في المسئلۃ والدعاء ۰(الدرالمنثور:۶/۳۶۵)
১। হযরত যাহ্হাক রা. সূরা ইনশিরাহ তথা আলাম নাশরাহ এর উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন, যখন তুমি ফরজ নামায থেকে ফারেগ হবে তখন আল্লাহর দরবারে দু‘আতে মশগুল হবে। (তাফসীরে দূররে মানসূর : ৬/৩৬৫)
إذا فرغت من الصلاۃ المکتوبۃ فانصب في الدعاء۰ )تفسیر ابن عباس : ۵۱۴)
২। হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন, “যখন তুমি ফরজ নামায হতে ফারেগ হও, তখন দু‘আয় মশগুল হয়ে যাবে।” (তাফসীরে ইবনে আব্বাস রা., ৫১৪ পৃঃ)
فانصب إلی ربک والدعاء، وار غب إلیہ في المسئلۃ ( تفسیرمظہري:۱/۲۹۴)
৩। হযরত কাতাদাহ, যাহহাক ও কালবী রা. হতে উক্ত আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত আছে, তাঁরা বলেন-‘ফরজ নামায সম্পাদন করার পর দু‘আয় লিপ্ত হবে’। (তাফসীরে মাযহারী, ১০/২৯৪ পৃঃ)
عن ابن عباس عن النبي صلی اللہ علیہ وسلم إن اللہ تعالی قال : یا محمد! إذا صلیت فقل : اللہم إني أسئلک فعل الخیرات وترک المنکرات وحب المساکین۰ (رواہ الترمذي : ۲/۱۵۹ الحدیث ۳۲۴۹)
৪। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা তাকীদ করে বলেছেন যে, হে মুহাম্মাদ! যখন আপনি নামায থেকে ফারিগ হবেন তখন এ দু‘আ করবেন, হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট ভাল কাজের তৌফিক কামনা করছি এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সাহায্য চাচ্ছি এবং আপনার দরবারের মিসকীন অর্থাৎ আল্লাহ ওয়ালাদের মুহাব্বত কামনা করছি….। (তিরমিযী শরীফ : ২/১৫৯ হাঃ নং ৩২৪৯)
আল্লাহ তা’আলার এ সমস্ত নির্দেশ দ্বারা বুঝা গেল যে, ফরজ নামাযের পর ইমাম ও মুসল্লীদের জন্য দু‘আ ও মুনাজাতে মশগুল হওয়া কর্তব্য, চাই তারা সম্মিলিতভাবে করেন বা প্রত্যেকে আলাদাভাবে করেন। তবে একই সময় আলাদাভাবে করলেও তা সম্মিলিত মুনাজাতের রূপ ধারণ করবে, যা অস্বীকার করা যায় না। চলবে……