সম্মিলিত মুনাজাত এর শর’ঈ বিধান।
তাম্বীহ
যারা ফরজ নামাযের পরে সর্বাবস্থায় ইজতিমায়ী মুনাজাতের বিরোধী, তারা হযরত আবু বকর রা.-এর আমলের ভুল অজুহাত দেখিয়ে সালাম ফিরানোর পর দেরী না করেই সুন্নত ইত্যাদির জন্য উঠে পড়েন। অথচ এর দ্বারা নামাযের পর যে মাসনূন দু‘আ ইত্যাদি রয়েছে, তা তরক করা হয়। দ্বিতীয়তঃ ফরজ ও সুন্নাতের মাঝখানে কিছু সময়ের ব্যবধান করার যে হুকুম হাদীস শরীফে পাওয়া যায়, তাও লঙ্ঘন করা হয়। তাদের জন্য নিম্মোক্ত হাদীসটি বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ
হাদীসঃ
আবু রিমছা রা. বর্ণনা করেন, একদা আমি নবী কারীম ﷺ-এর সাথে নামায পড়তে ছিলাম। হযরত আবু বকর ও উমর রা. ঐ নামাযে উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রথম সারিতে নবী কারীম ﷺ-এর ডান পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাদের সাথে এক ব্যক্তি ছিল, যে উক্ত নামাযে তাকবীরে উলা হতেই উপস্থিত ছিল। (অর্থাৎ সে মাসবুক ছিল না) নবী কারীম ﷺ নামায শেষ করে সালাম ফিরালেন এমনভাবে যে, উভয় দিকে আমরা তাঁর গন্ডদ্বয় দেখতে পেলাম। অতঃপর নবী কারীম ﷺ ঘুরে বসলেন। তখন ঐ তাকবীরে উলায় উপস্থিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পড়ল সুন্নাত নামায পড়ার জন্য। তৎক্ষণাৎ হযরত উমর রা. লাফিয়ে উঠলেন এবং ঐ ব্যক্তির উভয় কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন-“বসে পড়! পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের (ধর্মীয়) পতন হয়েছে, যখন তারা (ফরজ ও সুন্নাত) নামাযের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করত না।” নবী কারীম ﷺ হযরত উমর রা.-এর এ কাজ দেখে দৃষ্টি উঠালেন এবং বললেন, “হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহ তোমাকে সঠিক পন্থী বানিয়েছেন।” (আবু দাউদ শরীফ হাঃ নং ১০০৫)
পরিশিষ্ট
এ সকল বর্ণনার দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, নামাযের পর ইমাম-মুক্তাদী সকলের জন্য ওয়াজিব মনে না করে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। এ মুনাজাতকে বিদ‘আত বলার কোন যুক্তি নেই। কারণ-বিদ‘আত বলা হয় সেই আমলকে, শরীয়তে যার কোনই অস্তিত্ব নেই। আর মুনাজাত সেই ধরনের মূল্যহীন কোন আমল নয়। তবে যেহেতু মুনাজাত ‘মুস্তাহাব আমল’, তাই এটাকে জরুরী বা ওয়াজিব মনে করা এবং এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা অনুচিত। মুস্তাহাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ।
অতএব, কেউ মুনাজাতের ব্যাপারে যদি এমন জোর দেয় যে, মুনাজাত তরককারীকে কটাক্ষ বা সমালোচনা করতে থাকে, বা মুনাজাত না করলে তার সাথে ঝগড়া-ফাসাদ করতে থাকে তাহলে তারা যেহেতু মুস্তাহাবকে ফরজে পরিণত করছে সুতরাং সেরূপ পরিবেশে মুনাজাত করা মাকরূহ। মুনাজাত মাকরূহ হওয়ার এই একটি মাত্র দিক আছে। আর এটা শুধু মুনাজাতের বেলায় নয়, বরং সমস্ত মুস্তাহাবেরই এ হুকুম; মুস্তাহাব আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে, ঝগড়া বিবাদ শুরু করলে তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হবে। অতএব, মুনাজাতও পালন করতে হবে এবং বিদ‘আত থেকেও বাঁচতে হবে। আর এর জন্য সুষ্ঠু নিয়ম আমাদের খেয়াল মতে এই যে, মসজিদের ইমাম সাহেবান মুনাজাতের আমল জারী রেখে মুনাজাত সম্পর্কে মুসল্লীগণকে ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে বুঝাবেন এবং ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নাত-মুস্তাহাবের দরজা ও মর্তবা (ব্যবধান) বুঝিয়ে দিয়ে বলবেন, সালামের পর ইমামের ইকতিদা শেষ হয়ে যায়। ইমাম সাহেব মুস্তাহাব আমল হিসাবে মুনাজাত করতে পারেন, কোন জরুরী কাজ থাকলে মুনাজাত নাও করতে পারেন। তেমনিভাবে মুসল্লীগণের জন্য ইমামের সাথে মুনাজাতে শরীক হওয়া উত্তম, যদি কোন মুসল্লীর জরুরী কাজ থাকে তাহলে তিনি সালাম বাদ ইমামের সাথে মুনাজাতে শামিল নাও হতে পারে। বা মুনাজাত করা যেহেতু মুস্তাহাব, সুতরাং যার সুযোগ আছে, সে মুস্তাহাবের উপর আমল করে নিবে। আর যার সুযোগ নেই; তার জন্য মুস্তাহাব তরক করার অবকাশ আছে। এমন কি কেউ যদি ইমামের সাথে মুনাজাত শুরু করে, তাহলে ইমামের সাথে শেষ করা জরুরী নয়। কারণ সালাম ফিরানোর পর ইকতিদা শেষ হয়ে যায়। সুতরাং কেউ চাইলে, ইমামের আগেই তার মুনাজাত শেষ করে দিতে পারে। আবার কেউ চাইলে, ইমামের মুনাজাত শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ একা একা মুনাজাত করতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা শরী‘আতে নিষেধ। এভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর ইমাম সাহেবান প্রত্যেক ফরয নামাযের পর দায়িমীভাবে মুনাজাত করলেও তাতে কোন ক্ষতি নেই। অনেকের ধারণা মুস্তাহাব আমল দুয়ম করলে তা বিদ‘আত হয়ে যায়। সুতরাং ‘মুস্তাহাব প্রমাণের জন্য মাঝে মাঝে তরক করতে হবে।’ তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়িশা সিদ্দীকা রা. দায়িমীভাবে চাশতের নামায পড়তেন। কখনও পরিত্যাগ করতেন না। উপরন্তু তিনি বলতেন, “চাশতের নামাযের মুহূর্তে আমার পিতা-মাতা জীবিত হয়ে এলেও আমি তাদের খাতিরে এ নামায পরিত্যাগ করব না। (মুয়াত্তা মালেক পৃঃ ১১৬, হাঃ নং ১৯১) অথচ চাশতের নামায মুস্তাহাব পর্যায়ের। হযরত আয়িশা রা. দুয়ম পড়ার কারণে কি তা বিদ‘আত বলে গণ্য হয়েছিল? কখনোই নয়। তেমনিভাবে মুস্তাহাব প্রমাণের জন্য মাঝে মধ্যে তরক করার কোন আবশ্যকীয়তা নেই। যেমন-সকল ইমামই টুপি পরে, জামা পরে নামায পড়ান। কেউ একথা বলেন না যে, মাঝে মধ্যে টুপি ছাড়া জামা ছাড়া নামায পড়ানো উচিত-যাতে মুসল্লীগণ বুঝতে পারেন যে টুপি পরা বা জামা পরা ফরজ-ওয়াজিব আমল নয়। তাহলে মুস্তাহাব প্রমাণের জন্য মুনাজাতকে কেন ছাড়া হবে? অতএব মাঝে মধ্যে মুনাজাত তরক করে নয়, বরং ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমেই মুনাজাত মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেয়া যুক্তিযুক্ত। এটাই অদ্ভুত পরিস্থিতির উত্তম সমাধান। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে শরীয়তের সঠিক বিধান বুঝার এবং সুন্নাত মুতাবিক সহীহ আমল করার তাওফীক দান করুন-আমীন।
মুনাজাতের সুন্নাত তরীকা
১. মুনাজাতের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করা। (তিরমিযী হাঃ নং- ৩৪৭৬)
২. উভয় হাত সিনা বরাবর উঠানো। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাঃ নং – ৩২৩৪)
৩. হাতের তালু আসমানের দিকে প্রশস্ত করে রাখা। (রদ্দুল মুহতার : ১/৪৭৭, তাবারানী কাবীর হাঃ নং – ৩৮৪২)
৪. হাতের আঙ্গুলসমূহ স্বাভাবিক ফাঁক রাখা। (হিসনে হাসীন : ২৭)
৫. দু’হাতের মাঝখানে সামান্য ফাঁক রাখা। (ত্বহ্ত্বাবী টীকাঃ মারাকিল ফালাহ : ২০৫)
৬. মন দিয়ে কাকুতি-মিনতি করে দু‘আ করা। (সূরা আ‘রাফ : ৫৫)
৭. আল্লাহ তাআলার নিকট দু‘আর বিষয়টি বিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে বারবার চাওয়া। (বুখারী শরীফ হাঃ নং – ৬৩৩৮)
৮. নিঃশব্দে দু‘আ করা মুস্তাহাব। তবে দু‘আ সম্মিলিতভাবে হলে এবং কারো নামাযে বা ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টির আশংকা না থাকলে সশব্দে দু‘আ করাও জায়িয আছে। (সূরা আরাফ : ২০৫, বুখারী শরীফ হাঃ নং – ২৯৯২)
৯.আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা, যেমনঃ ‘সুব্হানা রাব্বিকা রাব্বিল ইয্যাতী’ শেষ পর্যন্ত পড়া; দরূদ শরীফ ও আমীন বলে দু‘আ শেষ করা। (তাবারানী কাবীর হাঃ নং – ৫১২৪, মুসান্নাফে আঃ রাজ্জাক হাঃ নং – ১১৭, আবু দাউদ হাঃ নং- ৯৮৩)
১০. মুনাজাতের পর হস্তদ্বয় দ্বারা মুখমণ্ডল মুছে নেওয়া। (আবু দাউদ হাঃ নং – ১৪৮৫)
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এর উপর আমল করার তাওফিক দান করুক।