খালিদ বিন ওয়ালিদের বিজ্ঞোচিত নেতৃত্ব
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্ধারিত তিনজন মহান আমিরের একে একে সবাই শাহাদাত বরণের পরে মুসলমানরা খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে তাদের আমির হিসেবে মনোনীত করলেন। যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু পতাকা নিজ হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। স্বভাবতই খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ছিলেন একজন বিজ্ঞ সিপাসালার। যুদ্ধের ভাব দেখেই তিনি গতি বলে দিতে পারতেন।
তাই তিনি দিনের শেষে মুসলিম বাহিনী নিয়ে কিঞ্চিৎ দক্ষিণ দিকে সরে গেলেন। আর শত্রুবাহিনী ময়দানের উত্তর দিকে চলে গেল। পরিশেষে রাত গভীর থেকে গভীর হলো। এক পর্যায়ে সেদিনের মত উভয় পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। এটা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই এর কাছে সুস্পষ্ট যে যুদ্ধের ময়দান থেকে পাশ কেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একটি কঠিন সামরিক সিদ্ধান্ত।
কারণ কখনো কখনো এ পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা কোনো বাহিনীর জন্য পরাজয় ডেকে আনে। আর সেটা হলে তো দুর্ভোগ আর দুর্ভাগ্যের কোন সীমা থাকে না। কিন্তু মুতার ময়দানে মুসলমানদের যে সামান্য ক্ষতির পরে তারা পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন সেটা ঐ বিশাল ফায়দা ও উপকারের সামনে একেবারে ম্লান হয়ে যায় যা তারা মুতার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন। তারা রোমানদের সমর শক্তির উৎস বিন্যাস, শৃঙ্খলা আর তাদের যুদ্ধকৌশল খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। ইতিপূর্বে যে ব্যাপারে তাদের খুব একটা ধারণা ছিল না। আর এই সুফল তৎক্ষণাৎ না বুঝা গেলও রোমানদের সঙ্গে মুসলমানদের পরবর্তী বিজয়গুলো ঠিকই সবার সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
খালিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তার সৈন্যদেরকে কয়েকটি ছোট ছোট দলে বিভক্ত করলেন। ভোরের আলো ফোটার মাত্রই তারা উচ্চস্বরে চিত্কার দিয়ে উটলেন। এতে শত্রুবাহিনীর ভেতরে বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়লো। তারা ভাবলো, নিশ্চিত ভাবেই মুসলমানদের কাছে নতুন সেনা সাহায্য এসে পৌঁছেছে। তখন তারা বলতে লাগলো মাত্র৩০০০ দিয়েই তারা যা করেছে এখন যদি নতুন আরো সেনা সাহায্য এসে থাকে তবে যে কি হবে তা কে জানে? এভাবে রোমান বাহিনী ভয় পেয়ে আর যুদ্ধের ময়দানে নামল না। আল্লাহ তাআলা তাদের বিপক্ষে মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট হলেন।
রণাঙ্গনের এক ঝিলিক
মুসলমানরা যখন মুতার রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন, ওদিকে মদিনায় বসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে মুতার যুদ্ধের সমস্ত সংবাদ শুনিয়ে যাচ্ছিলেন। আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় মূতার খবর পৌঁছার আগেই জায়েদ, জাফর ও ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর শাহাদাতের খবর আমাদের কে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছেন জায়েদ মুসলিম বাহিনীর পতাকা হাতে নিয়েছে এবং সে শহীদ হয়েছে। অতঃপর জাফর সেই পতাকা তুলে নিয়েছে সেও শাহাদাত বরণ করেছে। অতঃপর ইবনে রাওয়াহা সেই পতাকা হাতে নিয়েছে সেও শহীদ হয়েছে। তখন তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু দ্বারা প্রবাহিত হচ্ছিল। অতঃপর আল্লাহর এক তরবারী তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে তার হাত ধরে আল্লাহ তাআলা মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে তিনি মিম্বরে উপর বসে বলছিলেন, আমাদের কাছে থাকার চেয়ে ওখানটায় তাদের কাছে অধিক প্রিয়।
দুই ডানাওয়ালা উড়ন্ত জাফর
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর বিন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সম্পর্কে বললেন, আল্লাহ তাআলা মুতার যুদ্ধে তার হারিয়ে যাওয়া দুই হাতের বদলে জান্নাতে তাকে দুটি ডানা দান করেছেন। তার মাধ্যমে সে জান্নাতে যেখানে চায়, সেখানে উড়ে উড়ে যেতে পারবে। আর সে কারণে পরবর্তীতে তিনি উড়ন্ত জাফর ও দুই ডানা বিশিষ্ট জাফর নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
নববী মহব্বত আর মানবীয় দরদ
অতঃপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফরের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, জাফরের সন্তানদেরকে নিয়ে আমার কাছে চলে এসো। যখন তারা এল, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। তখন তিনি তাদেরকে জাফরের শাহাদাতের সংবাদ দেন। পরবর্তীতে যখন তাদের সকলের শাহাদাতের সংবাদ এল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাম নিজের পরিবারকে বললেন, তোমরা জাফরের পরিবারের জন্য খাবার রান্না করা। কেননা তারা বড় পেরেশান হয়ে পড়েছে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু সালামের চেহারা মোবারকে তখন বিষাদের ছাপ স্পষ্ট ছিল।
তারা যোদ্ধা; পালনকারী নয়
যখন মুসলিম বাহিনী মদিনার কাছাকাছি এসে পৌঁছল তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মুসলমানদের কে নিয়ে বের হলেন। ছোট ছোট বাচ্চারাও দৌড়ে আসছিল। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাঁর উটের ওপর ছিলেন। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা বাচ্চাদেরকে কোলে তুলে নাও, আর জাফরের সন্তানকে আমার হাতে দাও। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন জাফরকে নিয়ে আসা হলে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হাত দিয়ে নিজের সামনে বসালেন।
যেহেতু এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর কোনো নিষ্পত্তিমূলক ও সুস্পষ্ট বিজয় নিয়ে ফিরে আসতে পারিনি তাই কোন কোন লোক তাদের উপর মাটি ছুড়ে মারতে লাগল। আর তারা বলতে লাগল- হেই ভাগলপুরের দল!! তোমরা আল্লাহর রাস্তা থেকে পালিয়ে এসেছো!! তখন রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম বললেন, ইনশাল্লাহ তারা পালয়নকারী নয় বরং তারা জিহাদকারী।
মুতা ও মক্কা বিজয়ের মধ্যবর্তী অভিযান
গাজওয়ায়ে মুতা আর মক্কা বিজয়ের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেরণ করা হয়েছিল সারিয়ায়ে যাতুস সালাসিল।
এটা ছিল অষ্টম হিজরীর জুমাদাল উখরার ঘটনা। এটা ছিল ওয়াদিয়ে কুরার কাছাকাছি কুযআ জনপদে। মুসলিম বাহিনী শত্রুকে ধাওয়া ও পরাজিত করে মদীনায় ফিরে আসেন। এই সময়ে আরেকটি অভিযান ছিল সারিয়ায়ে খাবত। এর আমির ছিলেন, আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। এটা প্রেরণ করা হয়েছিল অষ্টম হিজরীর রজব মাসে। মুহাজির ও আনসার মিলিয়ে মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল তিনশজন।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম তাদেরকে সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি জুহাইনা জনপদের দিকে প্রেরণ করেছিলেন।নপথিমধ্যে তারা চরম ক্ষুৎপিপাসায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তারা ক্ষুধার তাড়নায় ‘খাবত’ তথা গাছের পাতা ভক্ষণ করতে থাকেন।পরিশেষে আল্লাহ তা’লা সমুদ্র থেকে তাদের জন্য আম্বর নামের একটি অতি দানবীয় মৎস্য পাঠিয়ে দেন। প্রায় অর্ধ মাস সময় তারা এটা খেয়ে পার করে দেন। তেল সংগ্রহ করে তা দিয়ে শরীরের যখম ইত্যাদি ভাল করেন। পরবর্তীতে যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনা শুনলেন, তখন বললে- ওটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য রিজিকের ব্যবস্থা। অতঃপর তিনি নিজেও তা থেকে সামান্য খেলেন।