Friday, March 29, 2024
No menu items!
Homeসিরাতুন নবী (সা.)হযরত হালিমা রা. এর ঘরে নবিজী সা. -এর প্রতিপালন ও দুগ্ধ পান

হযরত হালিমা রা. এর ঘরে নবিজী সা. -এর প্রতিপালন ও দুগ্ধ পান

হযরত হালিমা রা. এর ঘরে নবিজী সা. -এর প্রতিপালন ও দুগ্ধ পান- পর্বঃ ২, দ্বীন শিক্ষা.কম

আরবের এই সুপ্রাচীন প্রথার দরুন বনু সা’দ গোত্রের গোত্রের মহিলারা প্রতিবছর দুগ্ধপোষ্য শিশুর অন্বেষণে মক্কায় আসত। এ সম্পর্কে হুযুরের দুধমাতা হযরত হালিমা সাদিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন, আমি এবং বনু সা’দ গোত্রের অন্য আরও মহিলারা দুগ্ধপোষ্য শিশুর খুঁজে মক্কা শহরে এলাম। আমার সাথে ছিল আমার স্বামী এবং আমার এক দুগ্ধপোষ্য শিশু। বাহন হিসেবে ছিল অত্যন্ত দুর্বল শীর্ণকায় এক গাধী এবং একটি উষ্ট্রী। উষ্ট্রীটিও এত দূর্বল ও হীনস্বাস্থ ছিল যে, শত চেষ্টার পরও তার স্তন থেকে দুধ বের হতো না। ফলে সারা রাত আমরা ক্ষুধার কারণে অতিষ্ঠ থাকতাম; ঘুমাতে পারতাম না। আমিও ছিলাম অত্যন্ত রুগ্ন ও দুর্বল তাই আমার কোলে শিশুর কিছুতেই ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রাতভর কাদতে থাকত। কিন্তু আমার স্তনে একটি শিশুর ক্ষুধা নিবারণ ও তৃপ্তি প্রদান করার দুধ থাকত না। এ করুন অবস্থাতেই আমি মক্কায় গিয়ে উপস্থিত হলাম।


বনু সা’দ গোত্রের আগত মহিলাদের মধ্যে এমন কেউ ছিলো না যযার সম্মুখে শিশু মুহাম্মদকে উপস্থিত করা হয়নি। কিন্তু যখন মহিলারা শুনলো যে, এই ছেলেটি এতিম-পিতৃহীন, তখন কেউ আর তাকে নিতে রাজি হলোনা। তৎক্ষণাৎ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তারা ধারণা করে যে, শিশুর পিতা বেঁচে নেই তার সেবা-যত্ন করে কি -ইবা প্রতিদান পাওয়া যাবে।? কিন্তু তাদের কারো কী এ কথা জানা ছিল যে, এ শিশু নিছক পিতৃহীন অসহায় কোনো শিশু নয়, বরং দুর্লভ এক মহা মূল্যবান রত্ন, এমন এক মহিমাময় শিশু যার হাতে অনাগত ভবিষ্যৎ রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের কুঞ্জি তুলে দিবে। এ নশ্বর পৃথিবীতে যদিও মুরব্বী নেই, কিন্তু এই শিশুটির প্রকৃত অভিভাবক মহান আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলা। যার কোন কিছুর অভাব নেই, সকল কিছুর যিনি মালিক এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যিনি এই শিশুটির লালনপালনকারী ও দুগ্ধ দানকারীকে তার ধারণার অধিক প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।


বাস্তবে ঘটলও তাই। অন্য সকল মহিলা দুধের শিশু নিয়ে নিল। কেবল হালিমা কোন শিশু সংগ্রহ করতে পারলেন না। যখন ফিরে যাওয়ার সময় হল, তখন কোন কিছু না নিয়ে শূন্য হাতে ফিরে যাওয়া তার নিকট খুবই লজ্জাজনক ও খুব কষ্টদায়ক বলে মনে হতে লাগল। এ অবস্থায় অদৃশ্য থেকে হালিমার অন্তরে এই শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ও অদম্য ইচ্ছা সৃষ্টি হল, হালিমা তার স্বামীকে বললেন-
والله لاذهبن إلي ذالك اليتيم لاخذنه قال لا عليك عسي الله أن يجعل لنا فيه بركة-
আল্লাহর কসম! আমি ওই এতিম শিশুটির কাছেই যাবো এবং তাকেই নিয়ে আসবো। স্বামী এ কথা শুনে বললেন- ঠিক আছে, যাও। হতে পারে আল্লাহ তা’আলা এই শিশুটিকে ই আমাদের জন্য রহমত ও বরকতের কারণ ও মাধ্যম বানিয়ে দেবেন।
বরকত শব্দটির আভিধানিক অর্থ আসমানী মঙ্গল এবং ওই কল্যাণ ও মঙ্গল যা সরাসরি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি অবতীর্ণ হয়। তাতে বাহ্যিক কোন প্রকারের বিন্দুমাত্র দখল থাকে না।


-( ইমাম রাগেব ইস্পাহানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কৃত আল মুফরাদাত)
এক হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাবারক ওয়া তা’আলা বলেন-
أنا عند ظن عبدى بي-
আমার বান্দা আমার প্রতি যেরুপ ধারণা করে আমি তার সাথে এরূপ আচরণ করে থাকি। হালিমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বরকত প্রাপ্তির আশা নিয়ে এতিম শিশুটিকে সাথে করে নিয়ে এলেন। আল্লাহ তাআলা তার আশা অনুযায়ী তাকে আল্লাহ প্রদত্ত বরকতে অভিষিক্ত করেন, বরকতের দ্বারা উন্মোচন করে দেন। বনু সা’দ গোত্রের অন্য সকল মহিলা সৃষ্টিজগতের নিকট আশা করেছে, আর হালিমা স্রষ্টার নিকট প্রেরণ করেছেন।


হালিমা সাদিয়া বলেন, এই ভাগ্যবান শিশুটিকে কোলে নেওয়া মাত্র এবার বরকত প্রকাশ পেতে শুরু করলো। আমার স্তন ছিল একেবারে দুধহীন শুস্ক, কিন্তু কোনলে নেওয়ার সাথে সাথে তা দুধে ভরপুর হয়ে গেল। এত দুধ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো তৃপ্তির সাথে পেট ভরে পান করলেনই, আবার কুলের শিশুও পেট ভর্তি করে দুধ পান করল। আমার স্বামী ও উষ্ট্রীর দুধ দোহন করতে গিয়ে দেখতে পারেন উষ্ট্রীর স্তন দুধে ভরপুর। আমিও আমার স্বামী উদর পুর্তি করে তৃপ্তির সাথে দুধ পান করলাম। বহুদিন পর রাতে আরাম এর সাথে এই রাতটি অতিবাহিত হল।


ভোরবেলা আমার স্বামী বললেন-
تعلمي والله يا حليمه لقد أخذت نسمة مباركة-
হালিমা! তুমি ভালো করে বুঝে নাও, তুমি কিন্তু বড়ই বরকতময় শিশুকে নিয়ে এসেছ।
শুনে হালিমা বললেন-
والله اني لأرجو ذالك-
(আল্লাহর শপথ আমিও আল্লাহর নিকট এর আশায় পোষণ করেছি) এখন কাফেলার ফিরে যাওয়ার পালা। সকলেই নিজ নিজ বাহনে আরোহন করে চলতে শুরু করলেন। হালিমাও এই ভাগ্যবান শিশুকে সাথে নিয়ে তাদের সেই দুর্বল বাহনে সাওয়ার হলেন। হালিমার যে দুর্বল জন্তুটিকে আসার সময় চাবুক মেরে মেরে চালাতে হয়েছে তাই এখন এমন গতিতে চলতে লাগল যে, তা থামতেই কষ্টকর হয়ে গেল। এখন তো এটি একজন নবী কে বহন করে নিয়ে চলছে। তখন কাফেলার অন্য মহিলারা বলল, হালিমা এটা কি ঐ জন্তুটিই? এখনতো দেখছি এর গতি ও বৈশিষ্ট্যই পাল্টে গেছে।


এভাবে আমরা বনু সা’দ গোত্রের আবাসস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম। সে সময় বনু সা’দের এলাকা থেকে অধিক দুর্ভিক্ষ পীড়িত কোন স্থান ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় যখন আমর বকরিগুলো মাঠ থেকে ফিরে আসত, তখন সে গুলির স্তন থাকত দুধে পূর্ণ। অথচ অন্য সকলের ভেড়া-বকরী ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরে আসত। সেগুলির স্তনে এক ফোঁটা দুধও থাকতো না। এ অবস্থা দেখে লোকজন নিজ নিজ রাখালদের বলত, যেখানে হালিমার প্রাণীগুলো চড়ে, তোমরাও সেখানে তোমাদের প্রাণ এগুলো ছাড়াও। মালিকের নির্দেশ মেনে রাখালরা তাই করল।যেখানে হালিমার জন্তু চড়ে সেখানে তারাও চরতে দিল। কিন্তু বিকেল বেলা পূর্বের ন্যায় ঘটল। হালিমার জানোয়ারগুলো ফিরে আসলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে এবং অন্য সকলের গুলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরে আসলো। সেগুলো সব একেবারে দুধশূন্য।
হালিমা সাদিয়া বলেন, এভাবে আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি বিভিন্নভাবে বরকত বর্ষণ করেছিলেন এবং আমরা সুস্পষ্টভাবে তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং অনুভব করেছিলাম। রহমত ও বরকতের মাঝে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল আমি শিশু মুহাম্মদ কে দুধ পান করানো বন্ধ করে দিলাম।


-( হযরত হালিমার এ সমুদয় ঘটনা সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু আলোচনা শেষ অংশটুকু ভিন্ন এক রেওয়ায়েত থেকে নেওয়া হয়েছে, যা আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহির হাতে গড়া গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৫৪পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা তাবরানী, বায়হাকী নিজ নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বর্ণনার ভাষা হচ্ছে-
فلم يزل الله يرينا البركة ونتعرفها
সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থে এই কথাটি এসেছে নিম্নোক্ত ভাষ্যে-
فلم نزل نعترف من الله الزيادة والخير
এ উভয় বক্তব্য একত্র করে আমরা লিখছে।

হাফেজ ইবনে কাসীর বলেছেন, এ হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি ঐসকল হাদীসের অন্যতম যেগুলো নবীজীবনী রচয়িতাদের মাঝে গ্রহনীয় এবং যথেষ্ট খ্যাত ও শ্রুত।)
-( আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৭৫ )


যখন দুধ পানের নির্ধারিত সময় দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, হালিমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে মক্কায় এলেন, বিবি আমেনার গচ্ছিত ধন তাকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু যেহেতু নবীজির বরকতপূর্ণ অবস্থানের দরুণ আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানি ও বরকত লাভে তারা ধন্য হয়েছেন তাই বিবি হালিমা মা আমিনার নিকট নবীজিকে আরো কিছুদিন নিজের কাছে রাখার আবেদন জানালেন। সেই সময় মক্কায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, অপরদিকে বিবি হালিমা ও আধ্যাত্মিক পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তাই আমিনা তার আবেদন কবুল করে নিলেন এবং শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। হালিমা নবীজিকে নিয়ে বনু সা’দ গোত্রের অবস্থানে ফিরে এলেন। কিছুদিন পর তিনি তার দুধ ভাইয়ের সাথে বকরী চরাতে মাঠে যেতে লাগলেন।

  • (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৫৬,
    মাযমাউয জাওয়াইদ ৮/২২১
মুফতি নাজমুল হাসান সাকিব
মুফতি নাজমুল হাসান সাকিব
নাম: নাজমুল হাসান সাকিব পিতা: মুজিবুর রহমান স্থায়ী ঠিকানা: বাহেরবালী, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ। বর্তমান ঠিকানা: বসুন্ধরা, বারিধারা, ঢাকা ১২২৯ পড়াশোনাঃ- বাহেরবালী দারুল উলূম নূমানিয়া মাদরাসা, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ। (নূরানী টু হেদায়াতুন্নাহ্) জামিয়াতুস সালাম মদিনাবাগ, মুগদা, সবুজবাগ, ঢাকা। (কাফিয়া-শরহে বেকায়া) মারকাজুল উলূম আল-ইসলামিয়া মান্ডা, মুগদা, সবুজবাগ, ঢাকা। (আরবী স্নাতক ৪র্থ বর্ষ) মদিনাতুল উলূম বসুন্ধরা মাদরাসা ( হেদায়া) মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা। (এম এ- মাস্টার্স) আল মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ। (ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ) পেশা: লেখালেখি ও পড়াশোনা। (ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনো অধ্যায়ণরত)।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments