বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি বলে দেয় যে, বাংলাদেশে একটি বড় ধরণের সংঘাতের রুপ নিতে চলছে। বাংলাদেশের নিজিস্ব সংস্কৃতি আছে, নিজস্ব স্বকীয়তা আছে, আছে গৌরবময় ঐতিহ্য। যখন নিজিস্ব সংস্কৃতি, স্বকীয়তা এবং গৌরবময় ঐতিহ্য বিকিয়ে দিয়ে বিদেশী সংস্কৃতির আমদানি করা হয় তখনই বড় ধরণের সংঘাতের রুপ নেয়। কারণ হাজার বছর ধরে বাংলাদেশ মুসলমানদের একটি দেশ। তাই এদেশের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে মুসলমানিত্ব ও ধর্মীয় আবেশে। এদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে ইসলামিক সংস্কৃতি, সভ্যতা ও কৃষ্টি-কালচার। তাই এদেশের মানুষকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বাংলাদেশে ভাস্কর্যের সংস্কৃতি আমদানি করা যাবে না। আপামর তাওহীদি জনতা তা রুখে দিবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এদেশের কিছু নামধারী মুসলমান বাংলাদেশে মূর্তি ও ভাস্কর্যের সংস্কৃতি চালু করতে চাচ্ছে। তারা এ কথা বলতে চাচ্ছে যে ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। আর ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ হলেও ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়। তাই আমাদের মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্য জানা জরুরি।
ভাস্কর্য অর্থ : Sculpture (স্কলপচার) এককথায় বলতে গেলে যে সকল আকৃতি খোদাই করে তৈরী করা হয় তা ভাস্কর্য- রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া পড়ে না। আর যে সকল আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া প্রকাশ পায়, তা হল, মূর্তি। বিভিন্ন অভিধানে এভাবেই বলা আছে। (সংক্ষেপিত)
এখন প্রশ্ন হল, আমরা তো সকলেই মুসলমান। যদি মুসলমান হয়ে থাকি এবং ইসলামকে ভালবেসে থাকি তাহলে তো আপত্তি থাকার কথা নয়। তাহলে ইসলাম মানতে সমস্যা কোথায়? কারণ ইসলামে তো ব্যক্তিকে দেখে তার বিধান নাজিল হয়নি বরং আমির-ফকির, রাজা-বাদশা সকলের জন্যে একি বিধান। সেই বিধানকে কেন আপনারা জোর করে বৈধ করতে চান।
ইসলাম বলে প্রাণীর-মূর্তি তৈরী করা কঠিন কবীরা গুনাহ ও হারাম । মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা ইত্যাদি সকল বিষয় কঠিনভাবে নিষিদ্ধ।
কেউ কেউ তো মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য দেখাতে চান। এটা চরম ভুল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য। কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের স্পষ্ট নির্দেশ-
فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَ اجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّ۰
‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্ত্ত অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ -সূরা হজ্জ : ৩০
লক্ষণীয় বিষয় এই যে. উপরের আয়াতে সকল ধরনের মূর্তিকে ‘রিজস’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজ্স’ অর্থ নোংরা ও অপবিত্র বস্ত্ত। বোঝা যাচ্ছে যে, মূর্তির সংশ্রব পরিহার করা পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচায়ক।
আলী ইবনে আবী তালেব রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দিবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দিবে?’
আলী রা. এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্ত্তত হলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনো কিছু তৈরী করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।’ -মুসনাদে আহমাদ হা. ৬৫৭
এই হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, যে কোনো প্রাণী মূর্তিই ইসলামে পরিত্যাজ্য এবং তা বিলুপ্ত করাই হল ইসলামের বিধান। আর এগুলো নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।
এখন আপনারাই বলেন, মূর্তি ভেঙে ফেলা, সমাধিসৌধ মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া, ভাস্কর্য মুছে ফেলা, এগলো কি আলেম সমাজের কথা নাকি আল্লাহর রাসূল সা. এর কথা? আলেম সমাজ শুধু আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথাকে মাঠে নেমে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। মনে রাখবেন হয়তো আলেম সমাজ আজকে বিফল হবে কিন্তু আল্লাহর আজাব আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যেমন
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
إِنَّ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُوْنَ.
প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণী হল ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।’ -সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫০
আবু হুরায়রা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّ أَصْحَابَ هَذِهِ الصُّوَرِ يُعَذَّبُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَيُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوْا مَا خَلَقْتُمْ.
ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শষ্য কিংবা একটি যব! -সহীহ বুখারী হা. ৫৯৫৩
এই হাদীসটি বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যখন ভাস্কর-চিত্রকর, এমনকি গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদেরকে পর্যন্ত ‘স্রষ্টা’ বলতে এবং তাদের কর্মকান্ডকে ‘সৃষ্টি’ বলতে সামান্যতমও দ্বিধাবোধ করা হয় না। কোনো কোনো আলোচকের আলোচনা থেকে এতটা ঔদ্ধত্যও প্রকাশিত হয় যে, যেন তারা সত্যি সত্যিই স্রষ্টার আসনে আসীন হয়ে গিয়েছেন!
সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকানী রাহ. লেখেন- এই ভাস্কর ও চিত্রকর সর্বাবস্থাতেই হারাম কাজের মধ্যে লিপ্ত। আর যে এমন কিছু নির্মাণ করে যার পূজা করা হয় তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আর যে স্রষ্টার সামঞ্জস্য গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে সে কাফের ।’ -ফতহুল বারী ১০/৩৯৭
কুরআন ও সুন্নাহর এই সুস্পষ্ট বিধানের কারণে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল বিষয়ের অবৈধতার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দেখুন : উমদাতুল কারী ১০/৩০৯; ফাতহুল বারী ১০/৪০১; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম : ৪/১৫৯ #
সর্বশেষ আমি এতটুকু বলতে চাই যে আমরা মুসলমান। তাই মোহাম্মদী চেতনা-আদর্শে বেড়ে উঠা এদেশের সংস্কৃতিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির এই নগ্ন আগ্রাসন কেন? কেন আমাদের সংস্কৃতিতে শিরকী অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল? কারা আমাদের সহজ সরল মুসলমানদের মুশরেক বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, আর কারা নর্দমা সংস্কৃতির নীল বিষ এই সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে? এসব কিসের আলামত, তা যদি এখনই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে সেইদিন খুব বেশী দূরে নয় যেদিন আমরা আমাদের স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে ভিনদেশী হয়ে যাবো। পতাকা থাকবে কিন্তু স্বাধীনতা থাকবে না। অবয়ব মুসলমানের থাকলেও ঈমান আকীদায় মুসলমানের চিহ্নও থাকবে না।