ধন-সম্পদ আল্লাহ তালার দান। যেমন কাউকে হয়তো সম্পদ দান করেছেন, কাউকে দান করছেন বড় কোনো পদ কিংবা প্রসিদ্ধি- এ ধরণের মানুষ সাধারনতঃ গরীব, দুর্বল ও অসহায় মানুষদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, অবজ্ঞা করে। এজাতীয় লোকদেরকে সতর্ক করে বলা হচ্ছে, একজন মানুষ দৃশ্যতঃ হয়ত দুর্বল। হয়ত বা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল কিংবা শারীরিক দিক থেকে দুর্বল। তাই তাকে তুচ্ছ মনে করোনা। কে জানে, হতে পারে আল্লাহ তাআ’লার দরবারে তার মর্যাদা তোমার চেয়ে বেশি।
আল্লাহ তাআ’লা হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে বলেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ-
আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল-সন্ধ্যা তাদের পালনকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইবাদত করে। এমন যেন না হয় যে, আপনার দৃষ্টি তাদের দিক থেকে ঘুরে গিয়ে পার্থিব কোনো বিষয়ের প্রতি ধাবিত হয়। অর্থাৎ আপনি কখনও এ কথা মনে করবেন না যে, এরা গরীব, এবং নিম্নশ্রেণীর লোক। তাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন কিসের? তাই ধনীদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ।
কিন্তু গোটা কুরআন শরীফেের মধ্যে দু’স্থানে আল্লাহ তাআ’লা তার প্রিয় হাবীবকে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণ ভৎসনা করে বলেছেন, আমার পছন্দ হয়নি। তন্মধ্যে একটি স্থান হচ্ছে, সূরা আবাসায়। ঘটনা হচ্ছে, হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে কাফেরদের কিছু সরদার আসতো। এতে তিনি খেয়াল করলেন, এরা যেহেতু প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় লোক। তাই তারা যদি হেদায়েত প্রপ্ত হয় তাদের মাধ্যমে গোটা জাতির হেদায়েতের পথ উন্মোচিত হতে পারে। ফলে হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হৃদয় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাই তিনি তাদের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিলেন। এরই মাঝে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম যিনি একজন অন্ধ সাহাবী ছিলেন এবং মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিনও ছিলেন। তিনি আসলেন এবং হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছু মাসআলা জিজ্ঞাসা করেন। হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাবলেন এতো নিজেদের লোক, সদাসর্বদা মজলিসে উপস্থিত থাকেন, তার জিজ্ঞাসার জবাব এখন না দিয়ে পরেও দেওয়া যাবে। এই চিন্তা করে তিনি তাকে বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর। এই বলে তিনি মুশরিকদের সাথে পুনরায় আলাপে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ব্যস! ঘটনা শুধু এতটুকুই। কিন্তু এতেই আল্লাহ তাআ’লা হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সতর্ক করে দিয়ে আয়াত নাযিল করলেন-
عَبَسَ وَتَوَلَّى أَن جَاءهُ الْأَعْمَى
উক্ত আয়াতে হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করার জন্য উপস্থিত পদবাচ্য ব্যবহার না করে অনুপস্থিত পদবাচ্য অবলম্বন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মানের প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে এবং ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে কাজটি আপনার জন্য সমীচীন হয়নি। উক্ত আয়াতটিতে বলা হয়েছে তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
কারণ তার কাছে এক অন্ধ এসেছে।
وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى – أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ الذِّكْرَى
আপনি কি জানেন, হয়তো এই অন্ধ পরিশুদ্ধ হতো, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো। এতে আপনার উপদেশ ফলপ্রসূ হতো।
أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى – فَأَنتَ لَهُ تَصَدَّى
পরন্তু যে বেপরোয়া, ( উপকৃত হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে আপনার কাছে আসে নি, বরং এসেছে বেপরোয়াভাব প্রকাশ করার জন্য ) আর আপনি তার চিন্তায় মশগুল।
وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى
অথচ ( জেনে রাখুন ) এ ধরণের লোক পরিশুদ্ধ নাহলে এটা আপনার দোষ নয়। কারণ তার মাঝে তো সত্যকে জানার ও গ্রহণ করার আগ্রহ নেই। সুতরাং আপনি এ ব্যপারে জবাবদিহি করতে হবে না।
وَأَمَّا مَن جَاءكَ يَسْعَى – وَهُوَ يَخْشَى – فَأَنتَ عَنْهُ تَلَهَّى
আর যে আপনার কাছে দৌড়ে এসেছে এমতাবস্থায় যে, সে আল্লাহকে ভয় করে, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। [সূরা আবাসা]
উক্ত আয়াতসমূহে যদিও হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সমগ্র উম্মতকে এ শিক্ষাও দেয়া হয়েছে যে, বাহ্যিক দুর্বলতা দেখে কাউকে হীন ভেবো না। কারণ হতে পারে সে আল্লাহর দরবারে অনেক মর্যাদাবান।
গরিব-মিসকিনদেরকে অবজ্ঞা করা উচিৎ নয় কারণ আল্লাহ তাআ’লার দরবারে তাদঁর ফযিলত অনেক। হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ঈমান আনয়নকারী সাহাবায়ে কেরাম রা. এর মাঝে সবধরনের লোকই ছিলেন। বরং তাদের অধিক সংখ্যক সহায়-সম্বলহীন। সবাই হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে বসতেন। যেমনিভাবে হযরত উসমান রা. ও আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. এর মতো সম্পদশালী সাহাবারা বসতেন। তেমনি হযরত বেলাল হাবশি রা. হযরত সালমান ফারসি রা. এবং সুহাইব রুমির মতো প্রচুর্যহীন সাহাবারাও বসতেন। যারা কখনো লাগাতার দু-তিন দিন অনাহারে কাটিয়ে দিতেন। যাদের ভাগ্যে প্রায় সময় একটি রুটিও জুটতো না।
আল্লাহ তাআ’লা স্বয়ং রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গরিব-মিসকিনদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করার নির্দেশ দান করেছেন। তাদেরকে কাছে টেনে আনার নির্দেশ দিয়েছেন এবং দূরে সরাতে নিষেধ করেছেন।
আমরা যদি আরো একটি ঘটনা দিকে নযর দেই তাহলে হয়তো সহজে অনুমান করতে পারবো যে, আল্লাহ তাআ’লা কতটা সহানুভূতি ও ভালবাসা দেখিয়েছেন।
একদিন মক্কার কাফেররা হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো, আমরা আপনার নিকট আসতে চাই এবং আপনার কথা শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আপনার কাছে সর্বদা সাধারণ গরীব শ্রেণীর লোক বসে থাকে। তাদের সাথে বসা আমাদের মর্যাদার পরিপন্থী। এতে আমাদের প্রেষ্টিজে আঘাত আসে। তাই আপনি তাদের জন্য আলাদা মজলিসের ব্যবস্থা করুন, আমাদের জন্যও ভিন্ন মজলিসের ব্যবস্থা করুন। এরুপ করলে আমরা আপনার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত।
কাফেরদের এ প্রস্তাব দৃশ্যতঃ অযৌক্তিক ছিলা না। হতে পারে, হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা শোনে তারা নিজেদের ভূল শোধরে নিবে। আমরা যদি হতাম প্রস্তাবটি অবশ্যই মেনে নিতাম। তাই আল্লাহ তাআ’লা সাথে সাথে আয়াত নাযিল করলেন।
وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ
আপনি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিবেন না, যারা সকাল-সন্ধা আল্লাহ তাআ’লার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁকে ডাকে। [সূরা- আন’আম,আয়াতঃ ৫২]
তাই উক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে দিলেন, ‘যদি তোমরা সত্যের সন্ধ্যানি হও, তাহলে এ-সব নিঃস্ব ও গরীবদের সাথেই বসতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। সুতরাং তোমাদে জন্য ভিন্ন কোনো মজলিসের ব্যবস্থা করা যাবে না।
[সহিহ মুসলিম, কিতাবু ফাযায়িলিস সাহাবা]
আসুন গরীবদের প্রতি ঘৃণা নয়, তাদেরকে ভালবাসি। দূরে নয়, তাদেরকে বুকে টেনে নেই। সুখে-দুঃখে সদাসর্বদা তাদের পাশে দাড়াই।
সর্বশেষ আমাদের মহান রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরব একটি বানীর মাধ্যমে আমার আজকে লেখা শেষ করবো।
রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে, যে যমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করবে, আল্লাহপাকও তার প্রতি দয়া করবেন। আমিন