পৃথিবীটাতে মানুষ আজ প্রচন্ড লোভী হয়ে উঠছে। টাকার নেশায় মানুষ হারাম পথ-পন্থাও অবলম্বন করতে কুন্ঠিত হয়না। কীভাবে দু’টাকা আসবে- শুধু এই একই ধান্ধা, একটাই ফিকির। অথচ আমানতদারী, সততা, নিষ্ঠা, ধোকা না দেয়া এক সময় এ-সব ছিল মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য ও প্রতিক। আমানত-দিয়ানতকে তারা যে কোনো বিনিময়ে বজায় রাখতো। এটাই ছিল রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে নির্মিত সমাজের সাধারণ চিত্র। সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন সেই সোনালী সমাজের যোগ্য সদস্য। তারা প্রয়োজনে ক্ষতির ধাক্কা সামলাতেন, তবুও প্রতারণার আশ্রয় নিতেন না। ফলে আল্লাহ তাআ’লা তাদেরকে অনবদ্য মাধুর্যের প্রতিক হিসাবে গোটা দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করেছেন। এজন্য ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনীতিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে তারা উন্নতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর যাবতীয় শক্তি ও প্রাচুর্য তাদের পদতলে এসে পড়েছিল। সাধারণ মুসলমান তো পরের কথা, এমনকি আমাদের মধ্যে যারা নিয়মিত নামায আদায় করেন, তারা পর্যন্ত বাজারে গেলে ভূলে যায়, রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও আদর্শের কথা। ফলে দুর্দশা ও হতাশা আজ আমাদের নিত্য সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে।
ব্যবসায়িরা যেমন তাদের নীতি-আদর্শের কথা ভূলে গেছে আল্লাহপাকও তাদের ব্যবসা থেকে বরকত তুলে নিয়েছেন। আজকাল ব্যবসায়িরা মাপে কম দেওয়ার যেই প্রতিযোগিতা শুরু করেছে তাতে হয়তো সাময়িক লাভ দেখা গেলেও কিন্তু তাতে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশী। আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ডাণ্ডা মেরে এক ছটাক, দুই ছটাক, কিংবা এক তোলা, দুই তোলা হয়তো মেরে দিয়েছি, এর দ্বারা কয়েকটা পয়সা আমার ঝুলিতে হয়তো জুটেছে, মুলত এটা পয়সা নয় বরং আগুনের স্ফুলিঙ্গ। তোমার পেটে এ পয়সার কেনা মাল ঢোকাচ্ছ না বরং অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঢুকাচ্ছ। হারাম মাল এবং তার ভক্ষণকারী সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন –
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ الۡیَتٰمٰی ظُلۡمًا اِنَّمَا یَاۡکُلُوۡنَ فِیۡ بُطُوۡنِہِمۡ نَارًا ؕ وَ سَیَصۡلَوۡنَ سَعِیۡرًا
যারা ইয়াতিমের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করেব, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করছে এবং সত্ত্বরই তারা আগুনে প্রবেশ করবে। সূরা-নিসাঃ১০
মাপে কম দেওয়ার কারণে আল্লাহ তাআ’লা হযরত শুয়াইব আঃ এর জাতীকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। হযরত শুয়াইব আঃ আল্লাহর এক প্রেরিত নবী। নিজ কওমের কাছে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। তাঁর জাতি ছিল একটি অকৃতজ্ঞ জাতি। কুফুর, শিরক, মুর্তপূজাসহ নানা অপরাধে তারা নিমগ্ন ছিল। এছাড়াও একটি অপরাধ তাদের মাঝে ব্যপক ছিল। তাহলো তারা মাপে কম দিতো। এ ব্যপারে তাদের যথেষ্ট দুর্নাম ছিল। আরেকটি অপরাধও তারা করতো। তাহলো পথচারীদের মালামাল লুটপাট করে খেয়ে ফেলতো। হযরত শুয়াইব আঃ তাদরকে বুঝালেন। কুফুর, শিরক থেকে সতর্ক করলেন। তাওহিদের প্রতি আহবান জানালেন। ওজনে কম না দেওয়ার এবং পথচারীকে নিরাপদে সফর করতে দেওয়ারও নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাঁর জাতি ছিল নিজেদের কুকর্মে অটল, তারা শুয়াইব আঃ এর দরদমাখা কথার কোনো পাত্তা দিল না, বরং বললো-
أَصَلاَتُكَ تَأْمُرُكَ أَن نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا أَوْ أَن نَّفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَاء
আপনার নামায কি আপনাকে শিখায় যে, আমরা এইসব উপাস্যের পূজা ছেড়ে দেই, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যার পূজা করে আসছে ; আর আমাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ইচ্ছা মত ব্যবহার করার অধিকারী না থাকি? কোনটা হালাল আর কোনটা হারাম- সবই কি আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে করতে হবে? সূরা-হুদঃ ৮৭
হযরত শুয়াইব আঃ তাদেরকে যতই বুঝালেন, কোনো কাজ হল না। দুর্ভাগ্য তাঁর জাতির। অবশেষে তা-ই ঘটলো, যা নবীদের কথা অমান্য করলে ঘটে থাকে।
আল্লাহ তাআ’লা শুয়াইব আঃ এর জাতির উপর তীব্র গরম চাপিয়ে দিলেন। তিনদিন পর্যন্ত এ শাস্তি অব্যাহত থাকলো। সে এক অসহনীয় জ্বালা। আসমান থেকে যেন আগুন পড়ছিল, আর যমিন থেকে যেন আগুন উগলে বের হচ্ছিলো। ফলে তারা ঘরের ভেতরে ও বাইরে কোনো কোথাও শান্তি পেত না। তিনদিন পর হঠাৎ সেই জনপদের ওপর ঘাড় মেঘ দেখা দিলো। এ মেঘের নিচে সুশীতল বায়ু ছিল। গরমে অস্থির জাতি দৌড়ে দৌড়ে এ মেঘের নিচে জমায়েত হয়ে গেল, তখন মেঘমালা তাদের উপর পানির পরিবর্তে আগুন নিক্ষেপ শুরু করল। ফলে সবাই ছাই-ভস্ম হয়ে গেলে। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন-
فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمْ عَذَابُ يَوْمِ الظُّلَّةِ ۚ
তারপর তারা শুয়াইব আঃ কে মিথ্যাবাদি বললো, ফলে তাদেরকে মেঘাচ্ছন্ন দিবসের আযাব পাকরাও করলো। সূরা- শুআরাঃ ১৮৯
অন্যত্রে তিনি বলেছেন-
فَتِلْكَ مَسَاكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَن مِّن بَعْدِهِمْ إِلَّا قَلِيلًا وَكُنَّا نَحْنُ الْوَارِثِينَ
আমি অনেক জনপদকে ধ্বংস করেছি, যাদের অধিবাসীরা তাদের জীবন যাপনে মদমত্ত ছিল। এগুলো এখন তাদের ঘর-বাড়ী, তাদের পর এগুলোতে মানুষ সামান্যই বাস করেছে। অবশেষে আমিই মালিক রয়েছি। সূরা- কাসাসঃ ৫৮
যে ব্যক্তি ওজনে কম দেয় সে তো মনে করে, এর দ্বারা আমার সম্পদ বাড়ছে। অথচ এগুলো কিছুই তো আর কাজে আসবে না। [ইসালাহি খুুুুুুতুবাত অবলম্বনে]
যারা ওজনে কম দেয়, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহপাক পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন-
وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ-
দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়।
(১) تَطْفِيْفٌ এর অর্থ মাপে কম করা। যে এরূপ করে তাকে বলা হয় مُطَفَّف [কুরতুবী] কুরআনের এই আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসে মাপ ও ওজনে কম করাকে হারাম করা হয়েছে এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করার জন্য কড়া তাগিদ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ “ইনসাফ সহকারে পুরো ওজন ও পরিমাপ করো। আমি কাউকে তার সামর্থের চাইতে বেশীর জন্য দায়িত্বশীল করি না।” [সূরা আল-আনআমঃ ১৫২] আরও বলা হয়েছেঃ “মাপার সময় পুরো মাপবে এবং সঠিক পাল্লা দিয়ে ওজন করবে।” [সূরা আল-ইসরা: ৩৫] অন্যত্র তাকীদ করা হয়েছেঃ “ওজনে বাড়াবাড়ি করো না, ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না। [সূরা আর-রহমান: ৮–৯]। শু’আইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের ওপর এ অপরাধের কারণে আযাব নাযিল হয় যে, তাদের মধ্যে ওজনে ও মাপে কম দেওয়ার রোগ সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শু’আইব আলাইহিস সালাম এর বারবার নসীহত করা সত্বেও এ সম্প্রদায়টি এ অপরাধমূলক কাজটি থেকে বিরত থাকেনি।
তবে আয়াতে উল্লেখিত تَطْفِيْفٌ শুধু মাপ ও ওজনের মধ্যেই সীমিত থাকবে না; বরং মাপ ও ওজনের মাধ্যমে হোক, গণনার মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোন পন্থায় প্রাপককে তার প্রাপ্য কম দিলে তা تَطْفِيْفٌ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে। সুতরাং প্রত্যেক প্রাপকের প্রাপ্য পূর্ণমাত্রায় দেয়াই যে আয়াতের উদ্দেশ্য এ কথা বলাই বাহুল্য। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জনৈক ব্যক্তিকে আসরের সালাতে না দেখে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। সে একটি ওজর পেশ করল। তখন তিনি তাকে বললেন, طفَّفت অর্থাৎ “তুমি আল্লাহর প্রাপ্য আদায়ে কমতি করেছ।” এই উক্তি উদ্ধৃত করে ইমাম মালেক রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় দেয়া ও কম করা আছে। [মুয়াত্তা মালেক: ১/১২, নং ২২]। তাছাড়া ঝগড়া-বিবাদের সময় নিজের দলীল-প্রমাণাদি পেশ করার পর প্রতিপক্ষের দলীল-প্রমাণাদি পেশ করার সুযোগ দেয়াও এর অন্তর্ভুক্ত।
الَّذِیۡنَ اِذَا اکۡتَالُوۡا عَلَی النَّاسِ یَسۡتَوۡفُوۡنَ
যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে।
اِذَا کَالُوۡہُمۡ اَوۡ وَّزَنُوۡہُمۡ یُخۡسِرُوۡنَ-
আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়।
মাপে কম দেওয়ার রোগ থেকে আল্লাহপাক আমাদের সকলকে হেফাজত করুক। সততার সাথে ব্যবসা করার তাওফিক দান করুক। আমিন