মুফতি উবায়দুল হক খান: প্রত্যেক মানুষ নিজে সৎপথে চলার পাশাপাশি অপরকে সৎকাজের আদেশ করা এবং মন্দকাজ থেকে বিরত রাখাও উম্মতের বিশেষ জিম্মাদারি। এই মহান নবীওয়ালা জিম্মাদারীর বদৌলতেই উম্মতে মুহাম্মদী অন্যান্য নবীগণের উম্মতদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অনন্য মর্যাদা লাভ করেছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ করেছেন- তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা [মানুষকে] সৎকাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আর ঈমান রাখবে মহান আল্লাহর প্রতি।


মানুষের মধ্যে দীনের এ দাওয়াতি কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য হিকমত ও উত্তম ব্যবহার প্রদর্শনের পাশাপাশি মূলত দু’টি পদ্ধতি বা মাধ্যম ফলপ্রসূ। একটি হলো বয়ান বা বক্তৃতা, অন্যটি সাহিত্য বা লিখনী।
বয়ানের মাধ্যমটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক ও ক্ষণস্থায়ী। আর লিখনীর মাধ্যমটি বিস্তৃতসমৃদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও দাওয়াত-তাবলীগের কাজে সাহিত্য বা লিখনীর গুরুত্ব অপরিসিম।
দীনের খিদমতে লিখনী একটি মহাশক্তি। লিখনীর হিদায়াত মানুষের মনে সংগোপনে প্রভাব বিস্তার করে। লিখিত নসিহত যেন মানুষের সাথে একান্তে কথা বলে এবং অন্তরে অভূতপূর্ব বিপ্লব সৃষ্টি করে। এ কারণেই তো দেখা যায়, অনেক সময় অনেক কথা বলেও যাকে আমল বা কাজে জুড়ে দেয়া যাচ্ছে না, সে সংক্রান্ত লিখিত নুসখা তার হাতে আসার পর সে নিজ থেকে সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠছে এবং সে আমলে বা কাজে মনোনিবেশ করছে। এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক। তাই দীনের খিদমতে বয়ান বা বক্তৃতার পাশাপাশি লিখনীর খিদমতে ব্যাপকভাবে আত্মনিবেশ করা কর্তব্য। বিশেষ করে বর্তমান সাহিত্যের উৎকর্ষতার যুগে ইসলাম প্রচারে লিখনী এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।


বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে যারা এগিয়েছেন বা এগোচ্ছেন, তা অপ্রতুল। দীনের লেখকগণের আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে এ পথে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
জেনে রাখুন, লেখালেখির পথটি কিন্তু সহজ নয়। এ পথে কদমে কদমে রয়েছে পিচ্ছিলতা। দীর্ঘ সাধনা ও পরিশ্রমের কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করতে হয়। পাহাড়সম বাধা ডিঙ্গিয়ে, সমুদ্রসম পথ পাড়ি দিয়ে তা অর্জন সম্ভব। তাই বলে কি আমরা দমে যাব? না, কখনো নয়। চালিয়ে যেতে হবে সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা।
লেখকগণকে মনে রাখতে হবে, ভালো লেখক হতে হলে প্রথমে অবশ্যই ভালো পাঠক হতে হবে। পাঠক হওয়া ব্যতীত লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা বোকামী ছাড়া কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে বড় বড় লেখকদের লেখা গ্রন্থ’ বেশি বেশি পড়তে হবে।
লেখার মাধ্যমে ইলমে দীনের খিদমত করা সদকায়ে জারিয়ার সমতুল্য। একটি লেখা লেখকের জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পরও যুগ যুগ ধরে মানুষকে সুপথের দিশা দিতে পারে। আর এর সাওয়াব ও ফযীলত লেখকগণ মৃত্যুর পরেও লাভ করতে থাকবেন। এর সিলসিলাহ কিয়ামত অবধি বিদ্যমান থাকবে। অথচ অন্যান্য সাধারণ আমলের সাওয়াব মৃত্যুর সথে সাথেই বন্ধ হয়ে যায়।


এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের আমলের সাওয়াব বন্ধ হয়ে যায়, তবে কেবলমাত্র তিনটি আমলের সাওয়াব মৃত্যুর পরও জারি থাকে। তা হলো- ১. সদকায়ে জারিয়াহ। ২. দীনি ইলমের খিদমত, যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হতে থাকে। ৩. রেখে যাওয়া নেককার সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।


বর্তমানে আমাদের সমাজে বিভিন্ন রকমের কুসংস্কার ও নানাবিধ ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার হচ্ছে। একদল স্বার্থান্বেষী অসাধুরা তাদের মস্তিষ্ক কাজে লাগাচ্ছে এবং লেখার মাধ্যমে ইসলামকে বিকৃতি করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।
সরলমনা মুসলমানদের ঈমান হরণের চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের জনগণের কাছে হক-ইনসাফের দাওয়াত পৌঁছাতে হলে লিখনী অন্যতম হতিয়ার।


বস্তুত বাতিল যেখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সেখানেই হকের যা-াবাহী একঝাঁক ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এগিয়ে আসতে হয়। বামপন্থিরা যখন যা নিয়ে উদ্ধত হয় তখন তা দিয়েই তাদের মোকাবেলা করতে হয়। অস্ত্রের মোকাবেলা অস্ত্র দিয়ে, বাকশক্তির মোকাবেলা বক্তৃতার মাধ্যমে এবং লিখনী শক্তির মোকাবেলা লেখার মাধ্যমেই করতে হয়। যেখানে কথায় কাজ হয় সেখানে অস্ত্র ব্যবহার করার কোন যৌক্তিকতা নেই।


আবার বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের কাছে হকের বাণী পৌঁছানো সবার পক্ষে সম্ভবও নয়। পক্ষান্তরে লিখনী হচ্ছে এক নীরব হাতিয়ার। এর দ্বারা যে কেউ হক-ইনসাফের দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারে প্রতিটি মানুষের কাছে। ব্যক্ত করতে পারে তার যে কোন চিন্তা-চেতনা ও মনোভাব। আর মূলত সাহিত্যের শোভন হচ্ছে শালীনতা, সত্যবাদিতা, সৃজনশীলতা এবং নান্দনিকতা। অসত্য ও অশ্লীলতা কখনো সুসাহিত্য হতে পারে না। তা হলো সাহিত্যের আবর্জনা।


সাহিত্য নিয়ে বর্তমানে কদর্যতা চলছে। যেখানে অশ্লীলতা, মিথ্যাচার আর ধর্ম বিদ্ধেষের জোয়ার বয়ে চলেছে। আর বর্তমানে এ দেশের সাহিত্যিকদের সাহিত্য কর্মের বিরাট অংশই অশালীন ও ঈমান-আখলাক বিধ্বংসী উপকরণে ভরপুর। মাদরাসা পড়–য়াদের ঝাপিয়ে পরতে হবে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশাল অঙ্গনে। রুখতে হবে বাতিলের কলমী দাপট। এতেই রক্ষা পাবে মুসলিম সংস্কৃতি, চেতনা ও আদর্শ ভ্রান্ত সাহিত্যিকদের থাবা থেকে।
সুতরাং এসো বন্ধুরা! আগামী কর্ণধার হিসেবে আমরাই শুরু করি সাহিত্য আন্দোলন। ইসলামের চেতনায় আমাদের কলমকে করি ক্ষুরধার ও শাণিত। শুরু করি এক অবিশ্রান্ত কলমযুদ্ধ।

লেখক : সম্পাদক, সাহিত্য সাময়িকী ‘প্রতিভা’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here