প্রকাশ্য বিজয়
যখন যুদ্ধের ফলাফল পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। মুসলমানদের প্রকাশ্য বিজয় হলো। কাফেরদের লজ্জাজনক ভরাডুবি ঘটল। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর দিলেন- আল্লহু আকবার! সর্বমহান সেই সত্তা, যিনি আপন প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন। আপন বান্দাকে সাহায্য করেছেন। একাই এক বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেছেন।
কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন,
বস্তুত আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো।[ সূরা আলে ইমরানঃ ১২৩]
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে নিহত মুশরিকদের মরদেহ একটি কুপে ফেলে দেওয়া হয়। বস্তাপচা এই মরদেহগুলির উদ্দেশ্যে কূপের পাড়ে দাড়িঁয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে রাসূল্লাহর কন্ঠ ঠেলে বেরিয়ে এলো, হে কূপের অধিবাসীরা! তোমরা কি তোমাদের প্রভূর প্রতিশ্রুতি সত্য পেয়েছো? কেননা আমি আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য পেয়েছি।
ঐতিহাসিক সেই বদর প্রান্তরে মুশরিকদের সত্তর জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিল আর সত্তর জন হয়েছিল বন্দী। আর মুসলমানদের মধ্য থেকে মোট চৌদ্দ জন শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাদের ছয়জন ছিলেন মুহাজির আর আটজন আনসার।
ঈমানের বন্ধনের সামনে অসহায় আত্মীয়তার বন্ধন
বদর যুদ্ধে সাহাবী মুসআব বিন উমাইর রা. এর সহোদর ভাই আবু আযিয বিন উমাইর হাশিম বন্দী হয়েছিল। মুসআব বিন উমাইর রা. যেমন ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী, তার ভাই আবু আযিয বিন উমাইর ছিল মুশরিকদের পতাকাবাহী। এক আনসারি সাহাবী তাকে বন্দী করে বাধঁছিলেন এমন সময় মুসআব বিন উমাইর রা. সেখানে গমন করেন।
মায়ের পেটের ভাইয়ের চরম এই দুরবস্থায় মুসআব বিন উমাইর রা. এর ভূমিকা দেখে পৃথিবী সত্যিই সেদিন অবাক হয়েছিল। তিনি আনসারি সাহাবীকে বললেন, ভাই তাকে শক্ত করে বাধুন! তার অঢেল ঐশ্বর্যের অধিকারী। তার মাধ্যমে মোটা অংকের মুক্তিপণের আশা করা যায়। তখন আবু আযিয ভাইকে কাতর কন্ঠে বলল, ভাই! আমার প্রতি এই কি তোমার হিতকামনা? মুসআব বিন উমাইর রা. তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি আমার ভাই; তুমি নও! বস্তুত ঈমানের সুদৃঢ় বন্ধনের সামনে আত্মীয়তার নড়বড়ে বন্ধনের কখনোই দাম ছিল না।
বন্দীদের সঙ্গে মুসলমানদের আচারণ কেমন ছিল
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামকে বলে দিলেন- তোমরা তাদের সঙ্গে সুন্দর আচারণ করবে। মুসআব বিন উমাইর রা. এর ভাই আবু আযিযের বর্ণনা: বদর যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে মদিনায় আসার পর আমাকে এক আনসারির ঘরে দেওয়া হল। সকাল-সন্ধ্যায় খাবারের সময় হলে তারা কেবল আমাকেই রুটি দিতব আর নিজেরা থাকত শুধু খেজুর খেয়ে।
কারণ রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আমাদের সঙ্গে সুন্দর আচারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যখনই তাদের কারও কাছে এক টুকরা রুটিও থাকত তা আমাকে দিয়ে দিত। তখন আমি যদি তাদেরকে লজ্জাবশত ফিরিয়ে দিতাম তারা আবারও আমাকে দিয়ে দিত। সেটা হাত দিয়ে ছুয়েঁও দেখত না।
যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এর শাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব, চাচাতো ভাই আকিল ইবনে আবি তালিব ও জামাতা আবুল আস বিন রবি রা. ছিলেন। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে নিকট ও দূরের মাঝে, আপন ও পরের মাঝে কোনো ব্যবধান ছিল না। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান ছিল।
ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব: বন্দীদের মুক্তিপণ
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বন্দীদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। যার কারণে তাদেরকে হত্যা না করে কেবল মুক্তিপণ নিয়েই আযাদ করে দিয়েছিলেন। সকলের মুক্তিপণের অঙ্ক সমান ছিল না। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী তার মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়েছিল। যে সকল বন্দীর কুরাইশের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল কুরাইশরা তাদের মুক্তিপণের টাকা পাঠিয়ে দিল এবং এভাবে তাদের আযাদির ব্যবস্থা হয়ে গেল।
আর যাদের সামনে মুক্তিপণ আদায়ের কোনো পথই খোলা ছিল না। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহসান করে তাদের বন্দীত্বের শিকল খুলে দিলেন। এভাবে তারা তাদের কাঙ্খিত মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল। পৃথিবী আরেকবার অবলোকন করেছিল মুস্তফা চরিত্রের অনন্যতার আরেক ঝলক।
পাশাপাশি যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে অনেকের মুক্তিপণের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। তখন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য এক অভিনব মুক্তিপণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এটা ছিল জাহিলিয়াতের ঘনঘোর অন্ধকার জগতে আলোর সম্পূর্ণ নব জগতের উদ্বোধন। দেড় হাজার বছর আগের মধ্য যুগের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন আর মুর্খতার রাজ্য ঘারে চেপে বসা সেই অসভ্য পৃথিবীতে নবীয়ে আরাবি মুস্তফা চরিত্রের ভূমিকা দেখে আজও অবাক হয় আধুনিক পৃথিবী।
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দিলেন, যাদের মুক্তিপণের কিছু নেই ; তারা দশজন মুসলিম সন্তানকে লিখা-পড়া শিখাবে। কাতিবে ওহি যায়েদ বিন সাবেত রা. এভাবেই লিখা-পড়া শিখে ছিলেন। এর মাঝে ফুটে উঠে মুস্তাফা চরিতের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এতেই বিঝা যায় গোড়া থেকে শিক্ষার প্রতি ইসলামের কতটা অনুরাগ ছিল। বিজ্ঞজনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। লম্বা কথা-বার্তার ঝাঁপি খুলে বসার কোনো প্রয়োজন নেই।
নোট: ইতিহাস জানার কোনো বিকল্প নাই। ইতিহাস থেকে আমরা অনেক কিছু জানি, অনেক কিছু শিখি। আবার অনেক মহা মানবের জীবন ইতিহাস পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর ফেলি। কিন্তু আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি যে, হয়তো আমরা সাময়িক মজা অনুভব করি কিন্তু তার থেকে কোনো ফায়দা আমাদের হচ্ছে না। কিন্তু আমরা এমন একজন মহা মানবের জীবন আলোচনা করেছি যা, ফায়দা থেকে খালি খালি নাই।
দ্বীন শিক্ষা ডট কমের পক্ষ থেকে আমরা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনি থেকে যুদ্ধের কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সংক্ষিপ্ত আকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যদি কোনো ধরনের ভূল-ভ্রান্তি হয় আশাকরি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
প্রিয় পাঠক আমরা রাসূলে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এত পরিমাণ লম্বা করিনাই যাতেকরে পড়ে আপনারা বিরক্ত হন, আবার এত পরিমাণ সংক্ষিপ্তও করিনাই যাতে বিষয়টি পড়ে মনের মধ্যে তৃপ্তি না আসে। সর্বদিকে বিবেচনা করেই আমরা লেখাটাকে মধ্যম পন্থায় লিখেছি। আরও জেনে খুশি হবেন যে, আমরা এই লেখাটা যেই গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছি আর তা হল;
আস সিরাতুন নববীয়্যাহ
মুল লেখক:
আবুল হাসান আলী নদবী র.