Saturday, November 16, 2024
No menu items!
Homeসিরাতুন নবী (সা.)একজন বীরাঙ্গনা মুসলিম জননী

একজন বীরাঙ্গনা মুসলিম জননী

একজন বীরাঙ্গনা মুসলিম জননী

উম্মুল মুনিন আয়েশা রা. এ সময় অন্যান্য মুসলিম নারীর সঙ্গে বনু হারিসার একটি দুর্গে অবস্থান করছিলেন। তখন তার ওপর পর্দার হুকুম ফরয হয়েছিল। তিনি বর্ণনা করেন, এ সময় সা’দ বিন মুয়ায রা. সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার পরনে একটি বর্ম ছিল। কিন্তু ছোট হওয়ার কারণে তার হাত পুরোটাই বাইরে বেরিয়ে ছিল। তিনি কোরআনে কারীমের কয়েকটি আয়াত তেলওয়াত করছিলেন।

কিন্তু তার মা থামিয়ে দিয়ে দ্রুত পথ চলতে বললেন। আয়েশা রা. তার মা’কে বললেন, উম্মে সা’দ আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি- যদি বর্মটি আরেকটু লম্বা হত! আয়েশা রা. এর এই আশঙ্কা পরবর্তী সময়ে একশ’ তে একশ সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ এই যুদ্ধে সা’দ রা. এর বাহুদেশে একটি তীর বিঁধে এবং এটাই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অত্যাধিক রক্ত প্রবাহের কারণে পরবর্তীতে গযওয়ায়ে বনু কুরাইযার সময় শাহাদাত বরণ করেন।

আল্লাহ তা’লার জন্য আসমান আর যমীনের বাহিনী

প্রায় দীর্ঘ একমাস ধরে অব্যাহত গতিতে চলছিল দুঃসহ অবরোধের ধারাবাহিকতা। এতদিন মদিনা ধীরে ধীরে খাবার ও পানিশূন্য হয়ে পড়ছিল। মুসলিম বাহিনীর ওপর ক্ষুৎপিপাসা আর ক্লান্তির অভিসাপ চেপে বসতে শুরু করছিলব। অপরদিকে অবরোধকারী শত্রু বাহিনী ছিল পূর্ণ সতেজ প্রানবন্ত।
এতক্ষণে মুনাফিকদের গোমর ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।তাদের সত্যিকার চিত্র এবার সকলের সামনে পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছিল।

তাদের অনেকেই রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের খোড়া অজুহাত ছিল- বাড়িতে দরজা খোলা রেখেই তারা জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল। এবার তাদের গিয়ে সে দরজা তালা লাগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতপক্ষে রণাঙ্গন থেকে চম্পট দেওয়াই তাদের মুল লক্ষ্য-উদ্যেশ্য।


সত্যি কথা বলতে কি- বিস্তৃত পৃথিবীর বিশাল নাট্যমন্চে নতুন অভিষিক্ত ছোট এই দলটি তখন উভসংকটে পড়ে গিয়েছিল। বলতে গেলে এক মাহা বিপদের দুই চোয়ালের মাঝে তারা আটকে পড়েছিল। একদিকে সামনে এক দানবীয় শত্রু বাহিনীর সামনে তাঁরা দিনরাত শঙ্কিত ছিল অপরদিকে পেছনে গাদ্দার ইয়াহুদী গোষ্ঠীর কোনো ঘৃণ্য চক্রান্ত নিয়ে দারুণ উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সঙ্গে তারা দিন গুজরান করেছিল।

এমনই এক ঘোর কালো মেঘঘন মুসলিম উম্মাহর আকাশে হঠাৎ এক বিদুৎ তরঙ্গ খেলে যেতে দেখা গেল। কোথা থেকে যেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত দ্যুতির আত্মপ্রকাশ ঘটল। বনু গাতফানের জনৈক নুআইম ইবনে মাসউদ রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইতিঃপূর্বে গোপনে মুসলমান হয়েছি।

কিন্তু আমার কওম এখন পর্যন্ত সে সম্পর্কে জানেনা। তিনি আরও বললেন, আপনি আমাকে এখন যা করতে বলবেন আমি সবকিছু করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছি। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তাদের দলে তুমি কেবল একাই আমাদের সঙ্গে রয়েছো। তাই চুপচাপ এখনো তাদের সঙ্গেই থেকে যাও। আর পারলে আমাদের সাহায্য করতে থাক। কেননা মনে রেখ- কৌশলের নামই যুদ্ধ।


রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নুআইম ইবনে মাসউদ রা. সোজা বনু কুরাইযার কাছে চলে গেলেন। তিনি তাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বললেন যে, বনু কুরাইযাকে নতুন করে ভাবনা শুরু করতে হল যে, মদিনায় থেকে মদিনার লোকদেরকে ফেলে এত দূরের কুরাইশ ও বনু গাতফানের সঙ্গে মৈত্রী ও দুস্তি পাতিয়ে আসলে তাদের কোনো লাভ হয়েছিল কি-না? এ নিয়ে শুরু দরকষাকষি।

তিনি তাদেরকে উপদেশ দিলেন, এখন তোমাদের করণীয় হলো যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই কুরাইশ ও বনু গাতফানের কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তি জিম্মি স্বরূপ তোমাদের কাছে থাকবে। যাতে এই নতুন মিত্রের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ না থাকে। নুআইমের এই বিজ্ঞোচিত উপদেশ পেয়ে বনু কুরাইশ তাকে শতবার কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ জ্ঞাপন করল।


বনু কুরাইযা থেকে বিদায় নিয়ে নুআইম এবার সোজা কুরাইশ নেতৃবৃন্দের কাছে চলে গেলেন। অতঃপর তাদেরকে নিজের বিশ্বস্ততা ও আমানতদারী সম্পর্কে আশ্বস্ত করে বললেন, বনু কুরাইযা এখন এখন তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাচ্ছেনা। এ কারণে তারা এ চুক্তি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তোমাদের বিশেষ বিশেষ কয়েকজন লোককে জিম্মি স্বরূপ দাবি করবেব।

এর পাশাপাশি নুআইম আরও বললেন যে, বনু কুরাইযা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কথা দিয়েছে, তারা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে কুরাইশ ও বনু গাতফান এই দুই কওমের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে তুলে দিয়ে তাঁর প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করবে। এরপর তিনি সেগুলোর মাথা কাটবেন। বনু গাতফানের কাছেও নুআইম একই মিশন নিয়ে এই গল্পটি বলে শেষ করলেন।

এভাবে নুআইম ইবনে মাসউদ এর হাতে অবিশ্বাস আর অনাস্থার যে বীজ বপন করা হল সময়ের আবর্তনে তা, বনু কুরাইযা, কুরাইশ ও বনু গাতফানের এককে অন্যের প্রতি সন্দিহান ও সংশয়ভূত করে তুলল। অবস্থা বেগতিক দেখে ধূর্ত আবু সুফিয়ান ত্বরিতে মুসলমানদের উপর একটি ব্যাপক হামলার সিদ্ধান্ত নিলো। অতঃপর যখন তিনি ইহুদিদের সামনে অগ্রসর হতে বলল, ঠিক তখনই তারা কুরাইশ ও বনু গাতফান থেকে কয়েকজন ব্যক্তি জিম্মি স্বরূপ চাইল।

এভাবে নুআইম ইবনে মাসউদ এর কৌশল পুরোপুরি সফল হল। কুরাইশ ও বনু গাতফান প্রত্যয় ব্যক্ত করল, নুআইম ইবনে মাসউদ এর দেওয়া তথ্য পুরোপুরি সত্য ছিল। তখন তারা বড় কঠিন ভাষায় তাদের প্রস্তাব ছুড়ে ফেলে দিল। অপরদিকে বনু কুরাইযার বিশ্বাসেও ফাটল ধরল। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হল যে, তার মিত্রদ্বয় তার প্রতি মোটেও সত্যনিষ্ট ও আন্তরিক নয়। এই অনাস্থা আর অবিশ্বাস এভাবে তাদের সুদৃঢ় মৈত্রবন্ধন আর তাদের ঐক্যের রজ্জুকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। তাদের সকল শক্ত-সামর্থ্য, ধৈর্য আর স্থৈর্য খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলল।


ক্লান্তিকর দিনের শেষে রাত নামল চারদিকে ছিল কনকনে হাড়কাঁপানো শীত। রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশার মাত্রও বেড়ে চলতে লাগল। এক পর্যায়ে গোটা পৃথিবী ঢেকে গেল কুয়াশার চাদরে। কনকনে শীত আর হিমশীতল সেই মেঘমালা রাতে হঠাৎ মরু সমুদ্রে প্রবল ঝঞ্ঝা বয়ে গেল। অজানা কোণ থেকে উঠে আসা এক অপ্রতিরোধ্য বিদ্রোহী হারিকেনের ঘূর্ণিবাতে যাযাবর শাসক গোষ্ঠীর তাঁবু উড়ে গেল। উনুনের ওপর হাঁড়ি-পাতিল সব উল্টে গেল। আসমানের মালিকের পক্ষ থেকে প্রেরিত এই ঝড় শত্রু বাহিনীর দিলের সর্বশেষ শক্তিটুকুও বরফ বানিয়ে স্থবির করে দিয়ে গেল।

সর্বশেষ শক্তিটুকু ও বরফ বানিয়ে স্থবির করে দিয়ে গেল, কোরাইশ বাহিনীর সরদার আবু সুফিয়ান নিজের লোকদের কে ডেকে বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়, এই প্রতিকূল পরিবেশে আর এক মুহূর্তও অবস্থান করা আমার মতে সমীচীন হবে না, আমাদের সব ঘোড়াগুলো মারা পড়েছে, বনু কুরাইজা আমাদের সঙ্গে কৃত ওয়াদা রাখে নি,আর তাদের সম্পর্কে আমরা দারুন ভয়ানক অনেক কিছু জানতে পেরেছি,প্রবল দমকা হাওয়ার তাণ্ডবে আমাদের কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তোমাদের চোখের সামনে,আমাদের এখন রান্না বান্নার হাড়ি-পাতিল নেই আগুন-জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই,

এমনকি থাকারও জায়গা নেই তাই তোমরা ফিরে চলো, ব্যক্তিগতভাবে আমি চলে যাওয়ার নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, অতঃপর আবু সুফিয়ান দারুন রূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন, দ্রুত ছুটে গেলে নিজে উটের কাছে। সেটাকে বসিয়ে রেখে দুই পা বাঁধা ছিল, কিন্তু তিনি গিয়ে সেটার পিঠে বসে প্রহার করতে শুরু করলেন, এক পর্যায়ে প্রহারের তীব্র জালায়ন তখন পাগল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তখন তার পায়ের বাধন ছিড়ে গেল,

কিন্তু নিজের হাতে তিনি সেই বাঁধন খুলে পর্যন্ত দেননি,যখন বনগাঁ প্রাণ কুরাইশদের প্রত্যাবর্তনের সংবাদ জানতে পারল তখন সেই কনকনে শীতের রাতের ভয়াবহ অন্ধকারেই তারা দুষ্টু সমুদ্রের বুকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল, হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে দুশমনের গতিবিধির ওপর নজরদারি করার জিম্মাদারী পেয়েছিলেন,

যখন তিনি দুশমনের চরম লজ্জাজনক পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পেলেন তখন কনকনে শীতের রাতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না, শৈত্য কুহেলিকা দূরে ঠেলে ঘন কুয়াশার বুক চিরে ঐতিহাসিক বিজয় নিয়ে প্রস্থ পথে ছুটে গেলেন দরগাহে রিসালাতে,এদিকে রাতের তমসার কোলে সাহেবের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন প্রভুর সঙ্গে গভীর মিলাতিতে নীরব ছিলেন,

আধার রাতের কোলে জগৎ-সংসারে প্রভুর সান্নিধ্যে একান্ত প্রেম আলাপে নিমগ্ন ছিলেন, হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সবকিছু খুলে সবিস্তারে জানালেন, ভোর হলো গোটা দুনিয়া বাঁশী দেখল দুনিয়ার ইতিহাসের আরেকটি বিস্ময়কর অধ্যায়, দুশমনের কোন চিহ্ন কোথায় খুঁজে পাওয়া অসাধ্য ছিল, কল্পনাও করা সুযোগ ছিল না যে, কাল এখানে কত বড় শত্রুর রওনক ভরা অবস্থান ছিল।

রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম কে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।
মুসলমানদের এই বিজয় ছিল মূলত মহান কুদরতে বারি তা’লার এক অনন্য কারিশমা। কুরআনে কারীমে ইঙ্গিত দিচ্ছে এভাবে:

হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্বরণ কর, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল, অতঃপর আমি আমি তাদের বিরুদ্ধে ঝঞ্ঝাবায়ু এবং এমন সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেছিলাম, যাদেরকে তোমরা দেখতে না। [সূরা আহযাব:৯]

অর্থাৎ আল্লাহ তা’লা কাফিরদের ক্রুদ্ধ অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। তারা কোনো কল্যাণ পায়নি। যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ মুমিনদের জন্য যথেষ্ট যথেষ্ট হয়ে গেছেন। আল্লাহ শক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী। [ সূরা আহযাব : ২৫]

এভাবে ধীরে ধীরে মদিনার আকাশ থেকে পুঞ্জীভূত সেই ঘন কালো মেঘমালাগুলো কেটে গেল যা এতদিন তাকে দুর্ভাগ্যের গেরো-কলে ফেলে রেখেছিল। অথচ তাতে বৃষ্টিপাতের এতটুকু প্রয়োজন হলো না। হতাশা আর নিরাশার এই মেঘ কেটে যেতে কোথাও বজ্রপাতের দরকার হলো না। এক কুদরতে বারী তা’লার অসিম নুসরাতে এমনিতেই সেই কালো মেঘ কেটে গিয়ে মদীনার নীল আকাশ আবার আগের মতো সুনীল ও হাসি খুশিতে ভরে উঠল যা ছিল তার চিরচেনা প্রাণের ছবি।

সাহাবায়ে কেরাম এর উদ্দেশ্যে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন এই বছরের পর কুরাইশরা আর কোনোদিনও তোমাদের উপর আগে বেড়ে আক্রমণ করতে পারবে না। বরং এরপর থেকে তোমরাই আগে বেড়ে তাদেরকে আক্রমণ করবে।।

গযওয়ায়ে আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধে সাতজন মর্দে মুজাহিদ আল্লাহর রাহে তাদের জান কুরবান করে দিয়েছিলেন। আর বিপরীতে তাদের তরবারির আঘাতে খতম হয়েছিল আল্লহতে অবিশ্বাসী চারটি দুরাচার।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments