বিজয় মুসলমানদের পদচুম্বন করলো
সকল সৃষ্টির আঁধার কুদরতের বারী তা’লা মুসলমানদের উপর মদদ ও নুসরাতের দুয়ার খুলে দিলেন। তাদেরকে দেওয়া আপন প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করলেন। মুসলমানেরা মুশরিক বাহিনীকে তাদের শিবির থেকে বের করে ধাওয়া করতে লাগলেন। মুশরিকদের এতদিনের কাঙ্খিত বিজয় আশার ক্ষীণ রেখাটুকু দিগন্তে মিলিয়ে গেল। তাদের পরাজয়ের আর কোনো সন্দেহ বাকি রইলোনা। নারীরা কাপর উঠিয়ে যে যেই দিকে পারল ভাগতে লাগলো।
প্রতিকূলতার চরম তুফান: হুমকির মুখে মুসলমান
এভাবে যখন লজ্জাকর পরাজয়ের ভূত মুশরিকদের ঘাড়ে চেপে বসল। দিকভ্রান্ত হয়ে এদিক সেদিক যে যার মত করে পালিয়ে গেল। এক পর্যায়ে ময়দান ছেড়ে দূরে মহিলাদের আঁচল তলে গিয়ে আশ্রয় নিল। ঠিক তখনই ঘটে গেল এক সর্বনাশা ঘটনা। মানবতার ইতিহাস প্রত্যক্ষ করল এক বিদঘুটে বিকৃত দৃশ্য। মুসলমানদের কপাল ফেটে গেল।
যে যুদ্ধের পাল্লা এতক্ষণ মুসলমানদের পক্ষে ভারি ছিল চোখের পলকে তা হালজা হয়ে শুন্যে উঠে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। মনে হল এ তারাজুর পাল্লা বুঝি একটাই; তাও ঝুঁকে আছে মুশরিকদের দিকে! পাহাড়ে নিয়োজিত তীরন্দাজ বাহিনী যখন যখন মুশরিকদের এ পালায়নের দৃশ্য দেখল তখন তারাও নিজেদের স্থান ছেড়ে দিয়ে তাদের শিবিরের দিকে দৌড়াতে লাগলো। কারণ বিজয়ের ব্যাপারে তারা ছিল তখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী।
এতে তাদের এতটুকু সন্দেহ ছিলনা। তারা একে অপরকে বলতে লাগলো: ভাইয়েরা আমার! ঐ দেখ গনিমত!! ঐ তো দেখ গনিমত!! তাদের সালার তাদেরকে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কঠোর নির্দেশের কথা মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু তারা এদিকে কান দেওয়ার কোনো ফুরসত পেলনা। কারণ তাদের ধারণা ছিল, মুশরিকদের এখন আর দ্বিতীয়বার ফিরে আশার কোনো আশাই বাকি নাই।
এ কারণে তারা পালায়নের পথ বেছে নিয়েছে। এভাবে তারা সেখান থেকে চলে গেলেন। মুসলিম শিবিরের পৃষ্ঠদেশে দুশমনের অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিল। ওদিকে দুশমনের পতাকাবাহীদের ধারাবাহিক প্রাণনাশের কারণে তাদের পতাকা মাটিতে পড়ে রইলো। কেউ তা ময়দানে উঁচু করে দাড়ানোর সুযোগ ও সাহস পাচ্ছিলনা। ঠিক এ মুহুর্তে মুশরিকরা যম সেজে বাজপাখির মত হঠাৎ তাদের পেছনে এসে দাড়ালো। একদাগাষাড় বিকৃত চিৎকার করে উঠল-
লোক সকল! মুহাম্মাদ সাঃ নিহত হয়েছেন!! (নাউজুবিল্লাহ)
মুসলমানরা তখন পিছনের দিকে ফিরে আসতে লাগলো। মুশরিকরাও এ সময় তাদের ঘাড়ের ওপর এসে সওয়ার হলো। তারা এ স্বর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। বস্তুত এটা ছিল এক মহা পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধির দিন। দুশমন বাহিনী রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে তার উপর আঘাত হানলো। এক পর্যায়ে তিনি কাত হয়ে পড়ে গেলেন।
তার মুখের সামনের পাটির কয়েকটি দাত ভেঙে গেলো। মাথা ক্ষতবিক্ষত হলো। ঠোঁট ফেটে গেলো। বাঁধভাঙা খুনের ধারা মুখবদন অভিষিক্ত করে দেদারসে বইতে শুরু করল। তিনি সেগুলো মুছে ফেলছিলেন আর তাঁর যবান মোবারক থেকে অনবরত বের হচ্ছিল- সেই কওম কিভাবে সফল হবে যারা তার নবীর চেহারা রক্তাক্ত করে ফেলেছে; অথচ তিনি তাদেরকে তাদের রবের দিকে ডাকছে।
সাধারণ মুসলমানেরা ব্যাপকভাবে তখনো রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবস্থা জানতেন না। এ সময় আলী ইবনে আবি তালিব রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাত ধরলেন এবং তালহা বিন উবাইদুল্লাহ রা. তাকে উপরে তুললেন। এভাবে তিনি খানিকটা সোজা হয়ে দাড়াতে সক্ষম হলেন। মালিক বিন সিনান রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চন্দ্রবদন থেকে শোণধারা মুছে গিলে ফেলছিলেন। মুসলমানেরা ব্যাপকভাবে ভাগাভাগির আশ্রয় নেননি।
এ কারণে প্রান্তরের এ সাময়িক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে কখনো পিছুটান কিংবা পালায়ন বলে আখ্যা দেওয়া যাবেনা। বরং হঠাৎ পরিস্থিতি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করে সামান্য বিগড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই মুসলমানেরা আবার ঠিকই সাড়াশি হামলা চালিয়ে ছিল। বস্তুত এ সময় মুসলমানদের উপর আপদ আর মসিবতের যেই ঝটিকা বয়ে গিয়েছিল। তাতে বড় বড় মুজাহিদ আর ইসলামের অগণিত বীর-বাহাদুর পলকে ঝরে গিয়ে ছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের শক্তির গুরুত্বপূর্ণ মারকাযগুলো মত হারিয়ে গিয়েছিল।
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার দ্বীনের মদদ ও নুসরাতের উৎসধারাগুলো আজীবনের জন্য লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল- এ সবই ছিল তীরান্দায বাহিনীর সর্বনাশা পদস্খলনের ফলাফল। সর্বশেষ মুহুর্ত পর্যন্ত রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কঠোর নির্দেশের অনুবর্তী না থাকার পরিণাম। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতৃক নিযুক্ত মুসলমানদের পেছনের দুয়ার দুশমনের জন্য করে দেওয়ার নগদ পুরস্কার। এ সম্পর্কে
আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন-
ولقد صدقكم الله إذ تحسونهم بإذنه حتي اذا فشلتم وتنازعتم في الأمر وعصيتم من بعد ما أراكم ما تحبون منكم من يريد الدنيا ومنكم من يريد الآخرة ثم صرفكم عنهم ليبتليكم ولقد عفا عنكم والله ذو فضل علي المؤمنين
আর আল্লাহ সেই ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা তারই নির্দেশে ওদের খতম করেছিলে। এমন কি যখন তোমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলে ও কর্তব্য স্থির করার ব্যাপারে বিবাদে লিপ্ত হয়েছিলে।। আর যা তোমরা চাইতে তা দেখার পর কৃতঘ্নতা প্রদর্শন করেছ, তাতে তোমাদের কারো কাম্য ছিল দুনিয়া আর কারো কাম্য ছিল আখেরাত। অতঃপর তোমাদিগকে সরিয়ে দিলেন ওদের উপর থেকে যাতে তোমাদিগকে পরীক্ষা করেন। বস্তুত তিনি তোমাদিগকে ক্ষমা করেছেন। আর আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল। [ সূরা- আলে ইমরানঃ১৫২]