Saturday, November 16, 2024
No menu items!
Homeসিরাতুন নবী (সা.)প্রেম ও আত্মোৎসর্গের অবিশ্বাস্য দাস্তান

প্রেম ও আত্মোৎসর্গের অবিশ্বাস্য দাস্তান

প্রেম ও আত্মোৎসর্গের অবিশ্বাস্য দাস্তান

আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখবদনে শিরস্ত্রাণের ঢুকে যাওয়া দু’টি কড়ার একটি দাঁত দিয়ে টেনে বের করলে তাঁর একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। দ্বিতীয় কড়াটি যখন বের করলেন তখন তাঁর দ্বিতীয় আরেকটি দাঁত ভেঙে গেলো। সাহাবী আবু দুজানা রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য জীবন্ত মানব ঢালে পরিণত হলেন।

তিনি রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে দাড়িয়ে তার পৃষ্ঠদেশ দুশমনের তীরের নিশানা বানিয়ে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হেফাজতের কাজ আঞ্জাম দিতে লাগলেন। এক পর্যায়ে কতটি তীর এসে বিদ্ধ হয়েছিল তা গনে দেখাও মুশকিল ছিল। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে দাড়িয়ে তীর ছুঁড়ছিলেন।

রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার হাতে তীর তুলে দিচ্ছেলেন। আর তাকে বলছিলেন- তোমার উপর আমার পিতা-মাতা কুরবান হক; তুমি তীর ছুড়তে থাক। কাতাদা বিন নোমান রা. এর চোখে আঘাত লেগে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের মোবারক হাতে সেটা যথাস্থানে রেখে দেন। ফলে পরবর্তী সময়ে তার দুচোখের মধ্যে সেটাই ছিল অধিকতর সুন্দর আর সেটার দৃষ্টি শক্তিও ছিল দ্বিতীয়টার চেয়ে প্রখর।

মুশরিকরা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ করে আরও কাছে এগিয়ে এলো। অথচ আল্লাহর অভিরুচি ছিল তাদের অভিসন্ধির বিপরীত। মাত্র দশজন সাহাবীর ক্ষুদ্র একটি দল তাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। দুশমনরা একে একে তাদের সকলকে শহীদ করে দিল। এক তালহা বিন উবাইদুল্লা তখন কুদরতের এক বিস্ময়কর কারিশমা দেখিয়ে একাই তাদেরকে ধাবড়ে পিছু হাটতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজের হাতকে ঢালে পরিণত করে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে হেফাজত করছিলেন।

এক পর্যায়ে তার আঙুল আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে হাত অবশ হয়ে যায়। প্রাণবন্ত শোণ সঞ্চালনের ধারা চিরদিনের জন্য থেমে যায়। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন একটি উচু প্রস্তরখন্ডের ওপর উঠার এরাদা করলেন। কিন্তু দুর্বলতা ও জখমির কারণে পারলেন না। তালহা রা. তখন তাঁর নিচে বসে গেলেন। তিনি তালহার পিঠে চড়লেন।

তালহা রা. তাকে প্রস্তরখন্ডের ওপর উঠিয়ে দিলেন। ঠিক তখনই নামাযের সময় হয়ে গেল। তিনি বসে বসে নামায আদায় করলেন। যখন পরাজয়ের সর্বনাশা ঝটিকায় গোটা মুসলিম শিবির উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছিল; মুসলিম মুজাহিদদের হৃদয়-চাঁদোয়া উড়ে যাচ্ছিল; সবাই থেকে থেকে মুষড়ে পড়েছিল। তখনো সেই ঝটিকার সামনে দাড়িয়ে হাত ঠেলে তার বেগ ঘুরিয়ে দিয়ে প্রবল বিক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিলেন খাদিমুর রাসূল আনাস বিন মালেক রা. এর চাচা আনাস বিন নযর রা.।

সা’দ বিন মুয়ায রা. তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোথায় যাচ্ছো আবু উমর! আনাস রা. বললেন, সা’দ! উহুদ পর্বতের পেছন থেকে আমি জান্নাতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি। তাই সেদিকে ছুটছি। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আনসার ও মুহাজিরদের একটি ছোট দলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। ইতোমধ্যে তারা হাতিয়ার ফেলে বসে পড়েছিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের এ দশা কেন? তাঁরা বললেন, রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহত হয়েছেন।

তিনি বললেন তারপরে এ জীবন দিয়ে কি করবে? তোমরা দাড়িয়ে যাও! যে পথে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তোমরাও সে পথে প্রাণ বিলিয়ে দাও!! অতঃপর তিনি দুশমনের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং এক পর্যায়ে শাহাদাতের অমিয় সূধা পান করে তার প্রাণ পাখি স্রষ্টার দরবারে ঊর্ধ্বাকাশে উড়াল দিল।


আনাস রা.বললেন সেদিন তার শরীরে সত্তরটিরও বেশি আঘাত ছিল। আঘাতের কারণে আমরা কেউই তাকে চিনতে পারছিলাম না। পরিশেষে তার হাতের একটি আঙুল দেখে তার বোন তাকে চিনতে পেরেছিল।


যিয়াদ ইবনে সাকান রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে যুদ্ধরত পাচঁজনের একজন ছিলেন। একের পর এক তারা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে যিয়াদ রা. জখমের যন্ত্রণায় পড়ে গেলেন। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো! তখন তাকে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নিয়ে এলেন। তিনি রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কদম মোবারকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোবারক চরণেই কপোল রেখে তিনি চিরদিনের মতো শান্তির ছায়ায় ঘুমিয়ে গেলেন।


সাহাবী আমর বিন জামূহ রা. ছিলেন খোঁড়া। তাঁর দু’খানা পাই বিকল ছিল। ওদিকে তাঁর চারজন নওজোয়ান সন্তান রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে যুদ্ধ করত। উহুদ যুদ্ধের সময় রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা থেকে রওনা হচ্ছিলেন তখন তিনিও রণাঙ্গনে বের হতে চাইলেন। কিন্তু তার ছেলেরা পিতাকে বললেন, আল্লাহ তা’লা আপনাকে বিরাম দিয়েছেন। যদি আমরা যুদ্ধ করি আর আপনি বসে থাকেন তাতেই হবে। তা ছাড়া আপনার উপর জিহাদ ফরয নয়।


সন্তানদের এ কথা আমর বিন জামূহ রা. এর মন ভূলাতে পারলনা। পা বিকল হলেও তার মন ছিল দারুণ সচল। তিনি ছুটে এলেন তাঁর প্রিয় হাবিবের দরগাহে। আরয করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এই ছলেরা আমাকে আপনার সঙ্গে জিহাদে যেতে বারণ করেছে। অথচ আল্লাহর কসম! শাহাদাতের তামান্না আমার মনে সদা জগরুক। আমি আমার এই খোঁড়া পা দিয়েই জান্নাতের পবিত্র মাটি মাড়াতে চাই।

রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, কিন্তু আল্লাহ তা’লা তো তোমার উপর থেকে জিহাদের হুকুম রহিত করে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি সন্তানদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা তাকে বারণ করোনা! হয়তো আল্লাহ তা’লা তার কপালে শাহাদাত লিখে রেখেছেন। এভাবে সাহাবী আমর বিন জামূহ রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে উহুদ যুদ্ধে বের হলেন। এক পর্যায়ে এই খোঁড়া মানুষটি শাহাদাতের রঙে রেঙে উঠলেন। ভূলে গেলেন সংগ্রামঘন জীবনের সকল ঝড় আর ঝাঞ্ঝার সুদীর্ঘ ইতিহাস।

যায়েদ বিন সাবেত রা. বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে সা’দ বিন রবির তালাশে পাঠালেন। তিনি আমাকে বলে দিলেন, যদি তুমি তাকে জীবিত পাও তবে তাকে আমার পক্ষ থেকে সালাম বলবে। এরপর তুমি তাকে বলবে, রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তোমার কেমন লাগছে? যায়েদ রা. এর বর্ণনা, তখন নিহতদের মাঝে তাকে খুজতে লাগলাম।

এক পর্যায়ে তাঁকে পেয়েও গেলাম। তখন তাঁর জীবন সূর্য সাঁঝের মলিনিমায় ম্রিয়মাণ হয়ে বিদায়ের পাথারে ডুব দিতে যাচ্ছিল। আমি তাকে বললাম সা’দ! রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে সালাম বলেছে। তিনি আপনাকে আরও বলেছেন, আপনার কেমন লেগছে- তা আমাকে জানাবেন। সা’দ বিন রবি রা.জবাবে বললেন, আল্লাহর রাসূলের উপর সালাম। আপনি তাকে বলে দিবেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি জান্নাতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি। আর আমার আনসার কওমকে বলে দিবেন, যদি তোমাদের একটি নিঃস্বাসও বাকি থাকে আর এ অবস্থায় দুশমন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আল্লাহর কাছে তোমাদের জবাব দেওয়ার মতো কিছু থাকবেনা।

অতঃপর তিনি বেঘোর নিদ্রায় ঢলে পড়লেন। উহুদের দিন আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ রা. বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কসম করে বলছি- আগামীকাল শত্রুর মুখোমুখি হয়ে লড়াই করবো। অতঃপর তারা আমাকে হত্যা করে ফেলবে। আমার পেট ফুঁড়বে। আমার নাক-কান কেটে বিকৃত করে দিবে। অতঃপর তুমি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করবে এমনটি কেন করেছিলে? আমি তখন জবাব দিবো- তোমার জন্য।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments