হিজরতের পঞ্চম বর্ষে শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসে গযওয়ায়ে খন্দক কিংবা আহযাব নামে বিখ্যাত সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ জয় করতে গিয়ে মুসলমানদের দারুণ কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। ভাটির বিপরীতে উজান ঠেলে তাদরকে এ যুদ্ধের বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল। এটা সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই নতুন জাতিটির শক্তি আর সামর্থ্যের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা ছিল। কিন্তু সে ছিল তার পরীক্ষার জন্য সদ্য প্রস্তুত, পূর্ণজাগ্রত।
তাই সে তার জিন্দেগীর এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ভারি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিল। ফলাফল হলো, এই অপুর্ব বিজয় কেবল জাযীরাতুল আরব আর আরব দুনিয়াকেই তার সামনে মাথানত করিয়ে ক্ষ্যান্ত হলো না, বরং নিকট, দূর ও সুদূরের পৃথিবীকেও তাক লাগিয়ে বাকরূদ্ধ করে ছাড়লো। তার ঈমান আর বিশ্বাসের পয়গাম পৌঁছে দিল কাছে ও দূরের পৃথিবীর বিস্তৃত অঙ্গনে। সত্যি কথা বলতে কি, এটা ছিল ইসলাম ও অনৈসলামের মাঝে এক চুড়ান্ত লড়াই; এটা ছিল আলো আর অন্ধকারের মাঝে এক নিস্পত্তিকর সংঘাত। যার সুত্র ধরে মুসলমানদের তখন এতটা কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছিল যা সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি।
আল – কোরআনে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন,
অর্থাৎ যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিলে। সে সময়ে মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিল। [সূরা আহযাব : ১০-১১]
এখানে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমাদের মনে রাখতে হবে, আর তা হলো গযওয়ায়ে খন্দকের এই ঐতিহাসিক যুদ্ধের মূল ইন্ধন কিন্তু ইয়াহুদীরা যুগিয়েছিল।
বনু নযীর আর ওয়ায়েলের কয়েকটি ইতরপ্রাণ যারা প্রকাশ্যে দিবালোকে ইসলাম ও মুসলমানদের দুষমনি করতেও দ্বিধাবোধ করত না, তারা সোজা মক্কায় গিয়ে কোরাইশদের ডাকল এবং মদিনা থেকে মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণ উৎসাদিত করার নিমিত্তে লাঠি-সোঁটা নিয়ে হাঁটু গেড়ে তাদেরকে দাওয়াত দিতে লাগল। প্রথমে কুরাইশরা তাদের এ দাওয়াতে তেমন গরজ দেখাল না। কারণ এটা তাদের নিকট কোনো নতুন বিষয় ছিলনা। বরং এর আগেও আরও দুই দু’বার তারা খুব ভাল করেই এ দাওয়াতের মজা লুটেছিল। কিন্তু জনমভরেই যারা গাদ্দারি আর বিশ্বাস ঘাতকতার উপর ভর করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে অভ্যস্ত সেই ইয়াহুদী গোষ্ঠী সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না।
তারা পুরো মদিনার চিত্র মক্কার মুশরিকদের কাছে বর্ণাঢ্য ও চিত্তাকর্ষক করে পেশ করল। তাদেরকে তারা প্রতিশ্রুতির অভয়বাণী শোনাল- মনে রেখ! মুসলমানদের থেকে মদিনাকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে গোটা ইয়াহুদী জনগোষ্ঠী সবসময় সবকিছু নিয়ে তোমাদের পাশে থাকবে। এভাবে একসময় কুরাইশদের মন গলে গেল। ধূর্ত শয়তানের চক্রান্তের জালে নির্মমভাবে ফেসে গেল হাবাগোবা মুশরিক গোষ্ঠী। এখানেই অভিযানের ইতি টানল না। এই ছোট্ট প্রতিনিধি দলটি অনাগত এক শঙ্কিত ভবিষ্যতের বার্তা নিয়ে ছুটে গেল বনু গাতফানের দোরগোড়ায়।
মরু সমুদ্র এক অনাকাঙ্ক্ষিত নীরব অথচ ভয়ঙ্কর ঝড় তুলে মদিনাকে ধ্বংসের অমানুষী খেলায় মেতে উঠল। তারা বনু গাতফানের সবগুলো শাখাগোত্রকে দাওয়াত দিলন।ইসলামের বিরুদ্ধে কুরাইশদের দলে ভিড়ে সবাই একযোগে একটি ঝটিকা অভিযানের পরিকল্পনা করতে লাগল।
এভাবে কুরাইশ; ইয়াহুদী ও বনুগাতফানের মাঝে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী একটি গুরুত্বপূর্ণ মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
এই মৈত্রীচুক্তির গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই যে, বনু গাতফান এই যুদ্ধে ছয় হাজার সৈন্য দিবে আর তার বিনিময়ে ইয়াহুদীরা তাদেরকে খাইবারের এক বছরের উৎপাদিত সমস্ত শস্য দিয়ে দিবে। বনু গাতফানের দেখাদেখি কুরাইশরাও তাদের চার হাজার সৈন্য দেওয়ার প্রস্তাবে সম্মত হল। এভাবে ধীরে ধীরে জাযীরাতুল আরবের আকাশের এক কোণে দশ হাজার সৈন্যের পুঞ্জীভূত সর্বনাশা এই মেঘমালা কালো থেকে ঘোরতর কালো বর্ণ ধারণ করতে লাগল। অতঃপর আবু সুফিয়ানের হাত ধরে মদিনার পথে তারা অগ্রসর হতে লাগল।