ইলম: মুমিনের হারানো মানিক
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানতে পারলেন যে, শত্রু-শিবিরের এমন এক অভাবিতপূর্ব বিশাল বাহিনী নিয়ে ধীরে ধীরে মদিনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তিনি সঠিক করণীয় ও সুস্থির মতামতের জন্য সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল- মদীনার বাইরে গিয়ে উম্মুক্ত রণাঙ্গনে দুশমনের তরবারির নিচে মাথা বলি দেওয়ার চেয়ে মদিনার ভেতর থেকে শত্রুর সঙ্গে রক্ষণশীল আক্রমণ চালিয়ে যেতে হবে। শহর রক্ষার নিমিত্তে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন হাজার সশস্ত্র সেনা মোতায়েন করলেন।
এটা ছিল সেই ঐতিহাসিক মুহুর্ত এই উম্মতে মুহাম্মাদীর চিরন্তনতা ও অবিনশ্বরতা আর তার অনিঃশেষ যোগ্যতা ও প্রাণবন্ততার একটি বিশেষ দিক দারুণভাবে প্রকটিত হয়ে উঠছিল। মুসলিম উম্মাহর সদস্য ইরানি সাহাবী হযরত সালমান ফারসি রা. উম্মতের বিশেষ দুর্দিনে গোটা মদিনার চারপাশে পরিখা খননের পরামর্শ দিলেন।
এটা ছিল ইরান ও ইরানিদের বিশেষ পরিচিত ও জনপ্রিয় সমরকৌশল। অপরদিকে আরব আরবি দুনিয়ায় তা ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অকল্পিতপূর্ব একটি বস্তু। বর্ণিত আছে, সালমান ফারসি রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে লক্ষ করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের দেশে যখন আমরা অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণ নিয়ে দারুণ শঙ্কিত হতাম তখন আমরা আমাদের চারদিকে পরিখা খনন করে তাদের গতি ব্যাহাত করে দিতাম।
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে তার এ মতামতটি খুব ভালো লাগল। তিনি সেটা মেনে নিলেন এবং মদিনার উত্তর দিকের উম্মুক্ত প্রান্তে তিনি পরিখা খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কেবল এই উত্তরের উম্মুক্ত দিকটির কথা বাদ দিলে বাকি তিনদিক থেকে মদিনাকে সুরক্ষিত দূর্গ বলেই আখ্যা দিতে হবে। কেননা পুর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণ মদিনার এই তিনটি দিকেই সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে ছিল পাষাণকন্যা বিশাল পর্বতমালা, ঘন খেজুর বাগান ও পাথুরে যমিন। যেগুলি যে কোনো দুশমনের সামনে বিশাল প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
অতঃপর রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিখা খননের একটি পরিকল্পনা করে একটি ছক আঁকলেন এবং প্রতি দশজন সাহাবীকে চল্লিশ হাত লম্বা পরিখা খননের জিম্মাদারি দিলেন। পুরো পরিখার দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ হাজার হাত। গভীরতা ছিল সাত থেকে দশ হাত। আর তার প্রস্থ ছিল প্রায় নয় হাত বা তার সামান্য কম।
ব্যাপক উদ্দীপনা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার উদাহরণ
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও সাহাবায়ে কেরামকে পরিখা খননের কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। যদিও প্রবল কনকনে শীতের হিমেল দমকা হাওয়ায় দেহ-মন নেতিয়ে পড়ার কথা ছিল, প্রচন্ড খাদ্য আর পানাহার সংকটে তাদের জীবন দুর্বিষহ ও বিষিয়ে উঠার কথা ছিল- তারপরও পরিখা খননের কাজে এতটুকু বিলম্ব কিংবা শৈথিল্য কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছিল না। পুরো পরিবেশ জুড়ে কাজ করছিল প্রবল উদ্দাম আর উৎসাহের মানসিকতা।
সাহাবী আবু তালহা রা. বর্ণনা করেন, একবার তিনি নদারুন ক্ষুদার প্রচন্ড আঘাতে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে অভিযোগ করেন এবং তাঁকে নিজের পেটে বাঁধা একটি পাথর দেখান। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পেট খুলে তাঁকে দেখান তখন তাঁর পেট মোবারকে দুটি বড় বড় পাথর বাঁধা ছিল।
দারিদ্র্যের প্রবল ঝড় থেকে ধেয়ে এসে তাদের জীবনের ঝুপরি কাত করে ফেলে দিতে চাইলেও তারা খানিকের জন্য তার অনুমতি দিতে পারছিলনা। তাই এতসব ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও তারা ছিল দারুণ হাসি-খুশি। কাজের ভেতরে উৎসাহ আর উদ্যম অব্যহত রাখার উদ্দেশ্যে কারও কারও মুখ থেকে সময় সময় নিরন্তর ভেসে আসছিল গৌরব আর আল্লাহর স্তুতিমুলক বিভিন্ন কবিতা।
বাকি এক মুহুর্তের জন্যও কারও মুখ থেকে ভুলেও বেরোয়নি এতটুকু অভিযোগ।
আনাস রা. বর্ণনা করেন, পরিখা খননের সেই অবিস্মৃত দিনগুলোতে একদিন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ সাহাবায়ে কেরাম এর কাছে এলেন। তারা তখন পরিখা খননের কাজে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। প্রভাতি হাওয়ার ক্রমাগত প্রবল আঘাত সত্তেও আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম খননের কাজে এক মুহুর্তও বিরাম দিচ্ছিলেন না। তাদের পার্থিব এই দুরবস্থা আর ভূখা-দশা দেখে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন: আয় আল্লাহ! আখিরাতের জীবনই তো প্রকৃত জীবন: তাই আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দিন!!
প্রিয় হাবিবে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখে মালিকের দরবারে নিজেদের জন্য ফরিয়াদ শুনতে পেয়ে অভিভূত হয়ে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামও বলে উঠতেন:
আমরাই তো তারা, যারা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে ওয়াদাবদ্ব হয়েছে- জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আল্লাহর রাহে লড়ে যেতে।
আনাস রা. আরও বর্ণনা করেন, যদি কখনো কোথা থেকে কারও একমুঠো যব মুলে যেত সে তখন এগুলো পেষণ করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিত। যাতেকরে একাধিক মানুষ মিলে সেটা আহার করা যায়। অথচ তখনো তার ঘ্রাণ আর স্বাদ কিন্তু প্রশংসার উপযুক্ত ছিল না।