সাদা-কালো আল্লাহপাকই সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির পেছনে কারো কোনো হাত নেই। আল্লাহপাক যেমন চান তেমনই হয়। কপালের লিখন কেউ খণ্ডাতে পারেনা। অথচ কৃষ্ণাঙ্গদের কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় বর্ণবাদী হত্যা-নির্যাতন-বৈষম্য-অবিচার অতি সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা তাঁদের আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাসদের মানুষ বলেই মনে করেনা।
অথচ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাঃ কত সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন, যে সমাজ ব্যবস্থায় সাদা-কালোর, ধনী-দরিদ্রের, ইতর-মেতর, বাদশা-ফকির, দাস-দাসীদের কাউকেই দু-চোখে দেখা হয়না। সকলেই যাতে একই সমাজে বসবাস করতে পারে, একই ঈদগাহে নামাজ পড়তে পারে, একই মাসজিদে নামাজ পড়তে পারে অর্থাৎ যাতে বর্ণবৈষম্যের স্বীকার না হয় সেই ব্যবস্থা করে গেছেন এবং আমাদের নবী সাঃ বলেছেন, এক মুসলিম যাতে অপর মুসলিমকে কষ্ট না দেয়।
দুয়েকটা ঘটনার পরিপেক্ষেতে বিষয়টি আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা চালাব – ইনশাআল্লাহ
হযরত বেলাল রাঃ ছিলেন নবী মুহাম্মাদ সাঃ এর ঘনিষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবী। তিনি মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং আবিসিনিয়া বা হাবসি [ বর্তমান ইথিওপিয়া] বংশদ্ভূত ছিলেন। তিনি মক্কায় কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খলফের গোলাম ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তার মনিব দ্বারা অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হন। পরবর্তীতে হযরত আবু বকর রাঃ তাকে ক্রয় করে দাসত্ব ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করেন। হিজরতের পর মদিনায় থাকাকালিন অবস্থায় সর্বপ্রথম তিনি আযান দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর সঙ্গী হিসেবে প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদও তার জীবদ্দশায় নবী মুহাম্মাদ সাঃ এর কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনা আমরা দেখবো যে, ইসলাম কালো বা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মুল্যায়ন কিভাবে করেছে।
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার দৈহিক কৃষ্ণবর্ণ এবং আমার বিদঘুটে আকৃতি কি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি করবে? রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করলেন, না। যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, যদি তুমি তোমার প্রতিপালককে বিশ্বাস কর এবং তার রাসুল যা নিয়ে এসেছেন, তাঁর প্রতি ঈমান রাখ, তবে তা, কিছুতেই বাধা সৃষ্টি করবে না। লোকটি বলল, যিনি আপনাকে নবুওয়াত দান করে সম্মানিত করেছেন, তাঁর শপথ করে বলছি, এই মজলিশে বসার আট মাস পুর্বে আমি সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই আর মুহাম্মাদ সাঃ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।
আপনার নিকট যারা উপস্থিত আছে আর যারা উপস্থিত নাই, আমি এদের অনেকের নিকট বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছি। তারা আমার দৈহিক কৃষ্ণবর্ণ ও বিদঘুটে চেহারার কারণে আমার বিবাহের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ আমি আমার গোত্র বনু আসলামের মাঝে সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাবান। তবে আমার মামাদের দৈহিক কৃষ্ণবর্ণ আমার মাঝে প্রবল হয়েছে।
তখন নবী মুহাম্মাদ সাঃ বললেন, আজ কি আমর ইবনে ওহাব উপস্থিত হয়েছে? তিনি ছাকিফ গোত্রের নও মুসলিম ছিলেন। উপস্থিত সাহাবারা বললেন, না।রাসুলুল্লাহ সাঃ ঐ লোকটিকে বললেন, তুমি কি তার বাড়ি চিনো? লোকটি বলল, হ্যা। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, যাও, তার বাড়িতে গিয়ে দরযায় নাড়া দাও। সালাম দাও। তারপর ঘরে প্রবেশ করে বলো, রাসুলুল্লাহ সাঃ আমাকে আপনাদের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। তার একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী ছিল। লোকটি দরযায় এসে আওয়াজ দিল। সালাম দিল। আরবী ভাষা শুনে বাড়ির লোকেরা তাকে স্বাগতম জানিয়ে দরযা খুলে দিল। কিন্তু দৈহিক কৃষ্ণবর্ণ ও বিদঘুটে চেহারা দেখে তারা কুঞ্চিত হয়ে গেল। তখন লোকটি বলল, রাসুলুল্লাহ সাঃ আমাকে আপনাদের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। একথা শুনে তারা দুর্ব্যবহার করে তাকে তাড়িয়ে দিল। লোকটি তখন রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট ফিরে এলো। মেয়েটি এই অবস্থা দেখে তার পিতাকে বলল, হে আমার পিতা! ওহি আপনাকে অপমানিত করার পূর্বে আপনি নাজাতের চিন্তা করুন, পরিত্রাণের পথ অবলম্বন করুন।
যদি নবী মুহাম্মাদ সাঃ তার সাথে আমার বিবাহ দিয়ে থাকেন, তবে আল্লাহ ও তার রাসুল যে বিয়েতে রাযী, আমিও তাতে রাযী আছি। পিতা তখন রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট এসে তাঁর অতি নিকটে বসল।। রাসুলুল্লাহ সাঃ তাকে বললেন তুমিই কি আল্লাহর রাসুলের প্রস্তাবকে এমনিভাবে ফিরিয়ে দিয়েছো? পিতা বলল, করে ফেলেছি এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি ধারণা করে ছিলাম, তার কথা মিথ্যা। এখন যখন তাকে সত্যবাদী দেখছি, তার সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিলাম। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অসন্তুষ্টি থেকে আমি আশ্রয় চাচ্ছি।
তখন নবী মুহাম্মাদ সাঃ চারশত দিরহাম মহর ধার্য্য করিয়া বিয়ে দিয়ে দিলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, যাও। তোমার স্ত্রীর নিকট যাও। লোকটি বলল, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আমার অর্থ-সম্পদ কিছুই নেই। মুসলিম ভাইদের কাছ থেকে কিছু অর্থ চেয়ে নিয়ে নেই। রাসুলুল্লাহ সাঃ তখন বললেন, তোমার স্ত্রীর মহরের যিম্মা তিনজন মুমিনের উপর রইল। উসমান ইবনে আফ্ফান রাঃ এর নিকট যাও। তার থেকে দুইশত দিরহাম নাও। তিনি তাকে দু’শর বেশি দিলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাঃ এর নিকট যাও। তার থেকে দু’শ দিরহাম নাও। তিনি তাকে দু’শর বেশী দিলেন। আলীর নিকট যাও। তাঁর থেকে দু’শ দিরহাম নাও। তিনিও তাকে দু’শর বেশি দিলেন। তারপর লোকটি যখন বাজারে প্রফুল্লচিত্তে কেনাকাটা করছিল, ঠিক তখন রাসুলের ঘোষণাকারী ঘোষণা করল, জিহাদে চল! লোকটি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আসমান ও জমিনের ইলাহ্! মুহাম্মাদ সাঃ এর ইলাহ্! হে আল্লাহ আজ আমি এই দিরহামগুলো ঐ পথে খরচ করবো, যে পথে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং মুমিনরা খরচ করতে ভালবাসে।
সে একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার, একটি নেযা ও একটি ঢাল ক্রয় করল। মাথায় পাগড়ী বাঁধল। দেহ আবৃত করল। শুধু চক্ষু উন্মুক্তরইল। এমনি অবস্থায় এসে মুহাজিরদের সারিতে দাড়াল। মুহাজির সাহাবিরা বলল, এই অশ্বারোহী কে? আমরা তো তাকে চিনি না? আলী রাঃ বললেন, লোকটির কথা রাখ। হয়তোবা সে বাহরাইন বা শাম থেকে তোমাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে এসেছে। তারপর আজ যুদ্ধে তোমাদের সহয়তা করতে নেমেছে। যুদ্ধ শুরু হলে সে তার তরবারি ও নেযা দ্বারা ভীষণভাবে লড়াই শুরু করে দিল। ঘোড়াটি আহত হয়ে মৃত্যু বরন করলে সে বাহু থেকে কাপর গুটাল। কোমর বেধে মজবুত হল। ইতোমধ্যে আল্লাহর রাসুল তার বাহুর কৃষ্ণবর্ণ দেখে তাকে চিনে ফেললেন। বললেন তুমি কি সা’দ? লোকটি বললো, হ্যা, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন তুমি সৌভাগ্যবান হও। তারপর আবার সে তরবারি ও নেযা দ্বারা শত্রুদের সাথে প্রচন্ড আকারে যুদ্ধ শুরু করে দিল হঠাৎ সবাই বলতে লাগল সা’দ শহিদ হয়ে গেছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাঃ তার নিকট গেলেন। নিকটে পৌঁছে তার মাথা তুলে কোলে রাখলেন। কাপর দ্বারা তার চেহারা থেকে মাটি মুছে দিলেন। বললেন কি চমৎকার তোমার সৌরভ! আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিকট তুমি কতো প্রিয়! হাদিসটি বর্ণনাকারী আনাস রাঃ বলেন, এরপর আল্লাহর রাসুল কেঁদে ফেললেন। এরপর হেসে ফেললেন। এরপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এরপর বললেন, কা’বার প্রতিপালকের শপথ, সে হাউযে পৌঁছে গেছে।
আবূ লুবাবা রাঃ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত। হাউয কি? রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, আমার প্রতিপালক তাকে একটি হাউয দান করেছেন, যা সানআ থেকে বুসরার মধ্যবর্তী দূরত্ব তার প্রস্থ হবে। তার উভয় পার্শ্ব ইয়াকূত ও মুক্তা দ্বারা সুসজ্জিত। তার পানি দুধের চেয়ে সাদা এবং মধুর চেয়ে মিষ্টি। কেউ তার থেকে এক ঢুক পান করলে কখনো পিপাসার্ত হবেনা। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে কাঁদতে দেখলাম, এরপর হাসতে দেখলাম, এরপর মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখলাম! রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, সা’দের প্রতি অধিক আগ্রহে আমি কেঁদে ফেলেছি। আল্লাহর নিকট তার সম্মান ও মর্যাদা দেখে হেসে ফেলেছি। আর আমি ডাগরনয়না হূররা বাহু উম্মুক্ত করে, পায়ের মল প্রকাশ করে এগিয়ে এসেছে,তাই লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। তারপর তার অস্ত্র, ঘোড়া ও অন্যান্য আসবাব সম্পর্কে বললেন, এগুলো তার স্ত্রীর নিকট নিয়ে যাও এবং অভিভাবকদের বল, আল্লাহ তা’লা তাকে তোমাদের মেয়ের চেয়ে উত্তম মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
উপরোক্ত প্রবন্ধে আমরা দেখলাম বেলাল রাঃ কৃষ্ণাঙ্গ বলে আল্লাহর রাসুল তাকে খাটো করে দেখেননি বরং তার মর্যদাকে উঁচু করে দিয়েছেন। মাসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দান করেন এবং তার জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন।
এরপরে হযরত সা’দ রাঃ কৃষ্ণাঙ্গ ও চেহারা বিদঘুটে বলে দরবারে রিসালাত থেকে তাড়িয়ে দেননি বরং উচ্চবংশীয় রমনীর সাথে তার বিবাহ পড়িয়ে দেন এবং যুদ্ধের ময়দানে শহিদ হওয়ার পর রাসুলের কোলে মাথা রেখে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন।
এরই নাম হলো ইসলাম, এরই নাম হলো সাম্যতা।
সাদা-কালোর বিচারে কারো উপর নির্যাতন করা হয়না। কাউকে উপরেও তোলা হয়না, আবার কাউকে নিচেও নামানো হয়না। ইসলামের দৃষ্টিতে সকলেই সমান।
অথচ আমরা বিশ্বের অনেক দেশেই দেখতে
পাই, একটা মানুষ কৃষ্ণাঙ্গ বলে, তাকে মানুষ বলেই মনে করা হয়না।
ইউরোপ-আমেরিকার শেকড় থেকে শিখরে বর্ণবাদের কালো ছায়া লেগেই আছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি আটাইশ ঘন্টায় একজন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করা হয়। আর যারা বেচে থাকেন তাদের প্রতি অমানবিক আচারণ করা হয়।
রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাদা-কালো বৈষম্য। সমাজ ব্যবস্থায় গভীরভাবে গেথে আছে বর্ণবাদ।
তাই তো বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এটা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজের আদি প্রবাহ ও আমাদের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়।’
মানুষকে আল্লাহপাক সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ঘোষণা করেছেন, চাই সে সাদা হক বা কালো হক।
মানুষ হয়ে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ অপর মানুষকে অবজ্ঞা করা, নিচু মনে করা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচয়।
কোনও মানুষের গায়ের রং তার ইচ্ছানির্ভর নয়।
তাই আমাদের উচিৎ নিকৃষ্ট মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। কালো বলে অবজ্ঞা নয়, ভালোবাসা নিয়ে কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে সমাজে বসবাস করার নামই হলে উৎকৃষ্ট মানসিকতা।