ইসলাম শান্ত ও সমৃদ্ধির ধর্ম। ইহকাল ও পরকালের সকল সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধ এ ধর্ম অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব। ‘ ইসলাম ‘ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- আল্লাহ তা’লার আনুগত্য স্বীকার করা। অন্যদিকে সালাম শব্দের অর্থ হল- আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে মঙ্গল কামনা করা এবং তারই কাছে সফলতার দ্বারস্থ হওয়া।
পৃথিবীর বুকে বাস করে অসংখ্য মানব সন্তান। স্থান-কাল পাত্রভেেদে মানব জাতির মাঝে বিরাজ করছে বিভিন্ন ধর্ম। তাদের পরস্পরের দেখা সাক্ষাৎ ও মেলামেশার সময় পালন করা হয় নানাবিধ আচার-আচরণ। একে অপরকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন নিয়ম পদ্ধতি। ইসলাম ধর্মও তার অনুসারীদের চলাফেরা ও দেখা সাক্ষাতের সময় সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে একটি সুন্দর মার্জিত বিধান। আসসালামু আলাইকুম বলা সেই বিধানের একটি বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিক। ইসলাম ধর্মের অন্যতম আকিদা বিশ্বাস হল- সকল শক্তি ও ক্ষমতার উৎস হল আল্লাহ তা’লা। এই নশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষণাবেক্ষণকারীও তিনিই। এ কারণেই মুসলমানদেরকে তাদের প্রতিটি বিষয়েই প্রত্যাবর্তন করতে হয়, মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে। মুসলমানদের পরস্পরের দেখা-সাক্ষাৎ ও বিদায়লগ্নে সালাম দেয়ার যে বিধানটি আরোপ করা হয়েছে, তার অর্থ হল, আল্লাহর দরবারে সফলতা ও মঙ্গল প্রার্থনা করা। আর যে ব্যক্তির উপরে আল্লাহর পক্ষ থেকে মঙ্গলের ফায়সালা হবে, তার মনে কোন দুঃখ কষ্ট থাকতে পারেনা। সে হবে সুখী। সে হবে সফল।
বিশ্বের বুকে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মে সালামের পরিবর্তে যে কাজ বা কথার মাধ্যমে সালামের প্রতিফলন ঘটানো হয়ে থাকে, তা আদৌ সম্বধিত ব্যক্তির মঙ্গল কামনা নয় বা তা দোয়ার অর্থে ব্যবহার করেও করা হয়না; বরং এটি তাদের একটি যথারীতি প্রথা বা কুসংস্কার। উপমা স্বরুপ বলা যেতে পারে আগমন বা বিদায়লগ্নে হিন্দু ধর্মে নমস্কার, পদচুম্বন, জয়রাম, জয়চন্দ্রিমা ইত্যাদি বলা বা করা হয়ে থাকে। এগুলো দ্বারা শুধু নিজের আনুগত্য এবং বিনম্রতা প্রকাশ পায়, কিন্তু সম্বোধিত ব্যক্তির সুখ-শান্তি ও মঙ্গল কামনার কোনো প্রতিফলন এতে খুজেঁ পাওয়া যায়না।
চাই তা নমস্কার, কুর্নিশ, আদাব ইত্যাদি যে শব্দের দ্বারাই প্রকাশ করা হোক না কেন। নমস্কারের অর্থ হল- সম্বোধিত ব্যক্তির সামনে করজোড় হাতে বিনীতভাবে নিজকে অর্পণ করা। অনুরূপ কুর্নিশের দ্বারাও স্বীয় শির অবনত করে নিজের পুরো অস্তিত্বকে প্রতিপক্ষের সামনে বিলীন করে দেয়াই বুঝানো হয়ে থাকে। এগুলোকে যদি আমরা সম্মানের বাক্য-বচন বা আচার-আচরণ হিসেবে গ্রহণ করে নেই, তথাপি এগুলো যে প্রথাগত কার্যসূচি এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কেন্দ্রিক আচারমালা তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কেননা, এসব বাক্যমালা ও আচার-আচরণ সদাসর্বদাই নিম্নশ্রেণীর ও নিম্নবর্ণের লোকদের পক্ষ থেকে সম্পদশালী ও উচুঁবর্ণের লোকদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের প্রতি লক্ষ রেখেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। কোন সম্পদশালী ও উচুঁবর্ণের লোকদের পক্ষ থেকে নিম্নশ্রেণী বা নিম্নবর্ণের লোকদের প্রতি এমন সম্মানসূচক বাক্য ব্যবহার বা আচার-আচরণ প্রদর্শিত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত খুজেঁ বের করা মুশকিল।
অবশ্য এ ব্যপারে খৃষ্টান ধর্মানুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সামান্য স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হলেও মুসলমানদের সুমহান বিধানের সাথে তার কোনো তুলনাই চলেনা। তাদের ধর্মে সাক্ষাৎ ও বিদায়ক্ষণের ভাষা হল- ‘গুডমর্নিং ‘ বা ‘গুডনাইট ‘। যার অর্থ হল- ‘সুপ্রভাত ‘ ও ‘শুভরাত্রি ‘। এগুলোর দ্বারা যদিও সম্বোধিত ব্যক্তির উদ্দেশ্য দোয়া বা মঙ্গল কামনা করা হয়ে থাকে। তথাপি একটু তলিয়ে দেখলেই তার অসারতাও স্পষ্ট হয়ে উঠে। কেননা, সুপ্রভাত অর্থ হল- আপনার সকাল হোক মঙ্গল কামনাময়। আর শুভরাত্রি অর্থ হল- আপনার রাত্রি হোক মঙ্গল কামনাময়। এখানে তাদের মঙ্গল কামনাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে সকাল ও সন্ধার মাঝে। অথচ একজন মানুষের জীবনে দুপুর বেলার দীর্ঘ সময়টুকুও তার জন্য বয়ে আনতে পারে অনেক মঙ্গল, অনেক সফলতা। কিন্তু তাদের ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে একথাই প্রমাণিত হয় যে, একজন মানুষের দুপুর বেলার সময়টুকুর মোটেও মুল্য নেই।
একারণেই বলতে দ্বিধা নেই, মানব মস্তিষ্কের দ্বারা প্রস্তুতকৃত যে কোন কাজেই সীমাবদ্ধতা এসে যায়। অথচ আল্লাহর দরবারে দোয়া প্রার্থনা ও মঙ্গল কামনার জন্য কোনো সময় বা কালকে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন পড়েনা। আর একারণেই মুসলমানরা তাদের দেখা সাক্ষাৎ ও বিদায়ক্ষণের জন্য এমন একটি অর্থবহ বাক্যমালা বেছে নিয়েছে যা অন্যকোন ধর্মানুসারীদের মাঝে পাওয়া যায় না। সেই সর্বব্যাপী ও সর্বজনীন বাক্যমালাটি হল- “আসসালামু আলাইকুম” আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। যে শব্দের মাঝে নেই সময় ও কালের কোনো সীমাবদ্ধতা। এর দ্বারা সম্বোধিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দোয়া করা হয়ে থাকে সদাসর্বদা ও সার্বক্ষণিকের জন্য। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, কোনো খৃষ্টান কর্মচারী তার উর্ধ্বতন খৃষ্টান অফিসারকে দেখলে কোনো দরিদ্র খৃষ্টান ব্যক্তি সম্পদশালী ও প্রভাবশালী কোনো খৃষ্টান ব্যক্তিকে দেখলে তখন ঐ দরিদ্র ব্যক্তি এবং সাধারণ কর্মচারী সম্পদশালী ও অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘গুডমর্নিং স্যার’।
এর জবাবেও বলা হয়ে থাকে ‘গুডমর্নিং’ আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো শুধু ‘মর্নিং’ বলেই দায়িত্ব চুকানো হয়। কি জঘন্য শিষ্টাচার। একজনকে ‘গুডমর্নিং স্যার ‘ বলতে হয়, আর অপর জন শুধু ‘মর্নিং’ বলেই নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেয়ে যায়। কিন্তু এদিক থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র বলতে হবে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে। তাদের ভাষার মাঝে নেই কোনো ভেদাভেদ। পার্থক্য নেই ছোট বড় ও ধনী দরিদ্রের মাঝে। ধনী গরীব, ফকির বাদশাহ্ সকলকেই উচ্চারণ করতে হয় একটি মাত্র বাক্যমালা, “আসসালামু আলাইকুম “। এর জবাবেও সকলকেই বলতে হয়,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম”। সালামের উত্তরে সম্বোধিত ব্যক্তিকে এতটুকু তো অবশ্যই বলতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি এর সাথে ” ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু” অতিরিক্ত বলে, তবে তা ঐ ব্যক্তির জন্য অতি উত্তম। এই তো হলো মুসলমানদের সালাম আদান-প্রদানের সঠিক ও প্রকৃত পদ্ধতি।
অনৈসলামিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ
দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ মুসলমানরা বিধর্মীদের চিন্তা-চেতনা ও ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে পড়েছে চরমভাবে। আর এটা যে বিধর্মীদের পারিপার্শ্বিকতার ফসল, তা অস্বীকার করার কোনো কায়দা নেই। আজ অনেক মুসলিম পরিবারে আসসালামু আলাইকুমের পরিবর্তে আদাব, নমস্কার, ও কুর্নিশের ন্যায় অপসাংস্কৃতির প্রচলন দেখা যায়। অথচ এগুলো একেবারেই বিধর্মী ও হিন্দুদের নিজস্ব ধর্মীয় সামাজিক সংস্কৃতি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এসব কুসংস্কারের মাঝে দোয়ার দিকটি একেবারেই উপেক্ষিত। এর মাধ্যমে কেবল মাত্র সম্বোধিত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলমানদের সালাম এবং সালামের জবাব দানের নিয়ম-নীতি সরাসরি মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনের মাধ্যমে তার বান্দাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন। সালাম হল- ইসলাম ও মুসলমানদের অন্যতম স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মুসলমানরা আজ হিন্দু ও বিধর্মীদের অপসাংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ। যে কারণে মৃত্যুবার্ষিকী, শোকসভা ও বিবাহ-শাদী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এমনসব কুপ্রথা দৃষ্টিগোচর হয়, যা আদৌ ইসলামি শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; বরং এগুলো সরাসরি ইসলাম ও মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী বলেই মনে হয়। শুধু বিবাহ-শাদী নয় এধরণের অনৈসলামিক অসংখ্য কাজ কারবার আজ আমাদের দৈনন্দিন কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে যা আমরা নিজেরাও অনুভব করতে পারছিনা। ভারত বিভক্ত হয়েছে অর্ধশতাব্দী পূর্বে। তারপর বিভক্ত হল পাকিস্তান।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিন্দুদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। মুসলিম সত্তার উপর স্বাধীনতা অর্জনের পর এদেশের মুসলমানদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ ছিল বিধর্মীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভ করার। কিন্তু হলে কি হবে, এক ভূতের আছর যেতে না যেতেই আমাদের ঘাড়ে সাওয়ার হয়ে বসেছে অন্য আরেক ভূত। এখন আমরা আধুনিক সাংস্কৃতির নামে পাশ্চাত্যের নোংরা, উলঙ্গ সাংস্কৃতি আমদানিতে ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। বড় আক্ষেপ করে বলতে হয়, আজকে এই প্রবনতা শুধু আমাদের দেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি মুসলিম দেশেই এই কুসংস্কারের ব্যপক ছড়াছড়ি শুরু হয়েগেছে। এমনকি আজকে যারা তেল সম্পদের অধিকারী হয়ে বসে আছেন, তারাও পাশ্চাত্যের এই কুসংস্কৃতি আমদানির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
আল্লামা ইকবালের ভাষায়- নিজের খঞ্জর দ্বারা নিজেরাই রক্তে রঞ্জিত হচ্ছি।
পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত কুসংস্কারের প্রভাব আমাদের সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছে এবং ভবিষ্যতে এই মহামারী যে আমাদের সমাজকে আরও মহাবিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে তা থেকে পরিত্রাণের পথ একমাত্র আল্লাহ তা’লাই ভালো জানেন। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রতি সদয় হও এবং বিধর্মীদের অপসাংস্কৃতির সয়লাব থেকে আমাদের রক্ষা কর।
মধ্যপ্রাচ্য ও আরব মুলুকের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন সালামের প্রচলন উধাও হতে চলছে। তারাও আজ সালামের পরিবর্তে বলতে শুরু করেছে ‘সুবাহ বাখায়ের’ ‘মাসা বাখায়ের’ অর্থাৎ গুডমর্নিং এবং গুডনাইট। এটি মুসলমানদের জন্য একটি কলঙ্ক জনক অধ্যায়।।
স্বরণ রাখা উচিৎ, ইসলামী তাহযীব-তামদ্দুন ও শিক্ষাকে নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ ভেবে ইসলামী সাংস্কৃতির পরিহার ও বিলোপ সাধন করা মুসলমানদের জন্য মহাবিপর্যয় ও সর্বনাশ ডেকে আনবে। পরে আক্ষেপ ও অনুতাপ করেও কোনো লাভ হবেনা। সে সময় মুসলমানদের অবস্থা হবে- ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ -এর ন্যায়। তাই সাবধান মুসলমান, সময় থাকতে সাবধান।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে পরিস্থিতির ভয়াবহতা মুসলমানদের আতংকিত করে তুললেও নিরাশার অতল গহ্বরে হাবুডুবু খাওয়ার কোন কারণ নাই। কেননা, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের প্রক্রিয়া যতদিন অব্যহত থাকবে, ততদিন ইনশাল্লাহ আল্লাহর রহমত অব্যহত থাকবেএবং আবারো মুসলমানরা নিজেদের আদর্শের ঝাণ্ডা ধরে সামনে এগিয়ে যাবে। হে আল্লাহ! যাদের মাধ্যমে আমরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছি,তাদের ন্যায় দৃঢ়তা আমাদেরকে দান কর। আমাদের অন্তরে ইসলামের দাওয়াত ও জিহাদের প্রেরণা জাগিয়ে দাও।
এই আলোচনার পর থেকে আমরা পার্ট ভাই পার্ট সালাম সম্পর্কে লিখে যাব।
[{আমাদের এই লেখাটি পাকিস্তানের সিদ্দিকী ট্রাষ্ট কর্তৃক প্রকাশিত মাওলানা মনসুরুজ্জামান সিদ্দীকীর একটি উর্দু রেসালা]}
বাংলা অনুবাদ করেছেন, দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন বাতিলের কাছে আপোষহীন সিপাহসালার মুফতি ফজলুল হক আমিনী(রহঃ)। এই লেখাটি উৎসর্গ তার রুহের মাগফিরাত কামনায়।
আমাদের ফেসবুক পেজে এ যুক্ত হয়ে থাকতে পারেন এবং আমাদের কন্টেন্ট ভিডিও আকারে পেতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল টি সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারেন।