শিরক দুই প্রকার:
১. শিরকে আকবার (বড় শিরক) ও
২. শিরকে আসগার (ছোট শিরক)
১. শিরকে আকবার(বড় শিরক) যা বান্দাকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। এ ধরণের শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি যদি শিরকের উপরই মৃত্যুবরণ করে, এবং তা থেকে তওবা না করে, তাহলে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
শিরকে আকবর হলো গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া যে কোন ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর উদ্দেশ্যে কোন ইবাদত আদায় করা, গাইরুল্লাহর উদ্দেশে কুরবানী করা, মান্নাত করা, কোন মৃত ব্যক্তি কিংবা জ্বিন অথবা শয়তান কারো ক্ষতি করতে পারে কিংবা কাউকে অসুস্থ করতে পারে, এ ধরনের ভয় পাওয়া, প্রয়োজন ও চাহিদা পূর্ণ করা এবং বিপদ দূর করার ন্যায় যে সব ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ক্ষমতা রাখেনা সে সব ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আশা করা।
আজকাল আওলিয়া ও বুযুর্গানে দ্বীনের কবর সমূহকে কেন্দ্র করে এ ধরনের শিরকের প্রচুর চর্চা হচ্ছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইশারা করে বলেন:
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهَ
“তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তুর ইবাদত করে, যা না তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে, না করতে পারে, কোন উপকার। আর তারা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।”[সূরা ইউনুছ ১০:১৮ ]
২.শিরকে আসগার (ছোট শিরক) শিরক আসগার বান্দাকে মুসলিম মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের করে দেয়না, তবে তার একত্ববাদের আক্বীদায় ত্রুটি ও কমতি সৃষ্টি করে। এটি শিরকে আকবারে লিপ্ত হওয়ার ওসীলা ও কারণ। এ ধরনের শিরক দু’প্রকার:
প্রথম প্রকার: স্পষ্ট শিরক এ প্রকারের শিরক কথা ও কাজের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
কথার ক্ষেত্রে শিরকের উদাহরণ:
আল্লাহর ব্যতীত অন্য কিছুর কসম ও শপথ করা।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:“যে ব্যক্তি গাইরুল্লার কসম করল, সে কুফুরী কিংবা শিরক করল’ [তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং হাসান বলেছেন। আর হাকেম একে সহীহ বলে অবহিত করেছেন। হাদিস নং ১৫৩৫,মুসতাদরাক হাকিম,১/১৭]
অনুরূপভাবে এমন কথা বলা যে, ”আল্লাহ এবং তুমি যেমন চেয়েছ” ماشاء الله وشئت কোন এক ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “আল্লাহ এবং আপনি যেমন চেয়েছেন” কথাটি বললে তিনি বললেন, ”তুমি কি আমাকে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ স্থির করলে? বরং বল, আল্লাহ এককভাবে যা চেয়েছেন। [ইবনে আবি হাতিম, নাসায়ী-,৯৭৭,৩৭০৪]
কাজের ক্ষেত্রে শিরকের উদাহরণ
যেমন বিপদাপদ দূর করার জন্য কড়ি কিংবা দাগা বাঁধা, বদনজর থেকে বাঁচার জন্য তাবীজ ইত্যাদি লটকানো। এসব ব্যাপারে যদি এ বিশ্বাস থাকে যে, এগুলো বলা-মসীবত দূর করার মাধ্যম ও উপকরণ, তাহলে তা হবে শিরকে আসগার। কেননা আল্লাহ এগুলোকে সে উপকরণ হিসাবে সৃষ্টি করেননি। পক্ষান্তরে কারো যদি এ বিশ্বাস হয় যে, এসব বস্তু স্বয়ং বালা- মুসীবত দূর করে, তবে তা হবে শিরক আকবর। কেননা এতে গাইরুল্লাহর প্রতি সেই ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট।
দ্বিতীয় প্রকার: গোপন শিরক
এ প্রকার শিরকের স্থান হলো ইচ্ছা, সংকল্প ও নিয়্যাতের মধ্যে। যেমন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও প্রসিদ্ধি অর্জনের জন্য কোন আমল করা। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায় এমন কোন কাজ করে তা দ্বারা মানুষের প্রশংসা লাভের ইচ্ছা করা। যেমন সুন্দর ভাবে নামায আদায় করা, কিংবা সদকা করা এ উদ্দেশ্যে যে, মানুষ তার প্রশংসা করবে, অথবা সশব্দে যিকির- আযকার পড়া ও সুকণ্ঠে তেলাওয়াত করা যাতে তা শুনে লোকজন তার গুণগান করে। যদি কোন আমলে রিয়া তথা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য সংমিশ্রিত থাকে, তাহলে আল্লাহ তা বাতিল করে দেন।
আল্লাহ বলেন:
فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
“অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে ” [সূরা কাহাফ,১৮: ১১০]
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমাদের উপর আমি যে জিনিসের ভয় সবচেয়ে বেশী করছি তা হল শিরকে আসগর। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রসূলাল্লাহ! শিরকে আসগর কি? তিনি বললেন: রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা) ” [আহমদ ৩/৩০,ইবনে মাজাহ হা নং৫২০৪, তাবারানী, বাগাভী]
পার্থিব লোভে পড়ে কোন আমল করাও এ প্রকার শিরকের অন্তর্গত। যেমন কোন ব্যক্তি শুধু মাল- সম্পদ অর্জনের জন্যেই হজ্জ করে, আযান দেয় অথবা লোকদের ইমামতি করে, কিংবা শরয়ী জ্ঞান অর্জন করে বা জিহাদ করে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“দীনার, দিরহাম এবং খামিসা- খামিলা (তথা উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ) এর যারা দাস, তাদের ধ্বংস। তাকে দেয়া হলে সে সন্তুষ্ট হয়, আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়।” ( সহিহ বুখারী :: খন্ড ৮ :: অধ্যায় ৭৬ :: হাদিস ৪৪৩)
ইমাম ইবনুল কাইয়েম (রহ) বলেন সংকল্প ও নিয়্যাতের শিরক হলো এমন এক সাগর সদৃশ যার কোন কূল- কিনারা নেই। খুব কম লোকই তা থেকে বাঁচতে পারে। অতএব যে ব্যক্তি তার আমল দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু ও গাইরুল্লাহর কাছে ঐ আমলের প্রতিদান প্রত্যাশা করে, সে মূলতঃ উক্ত আমল দ্বারা তার নিয়ত ও সংকল্প নিয়্যত খালিছ ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে করা। এটাই হলো সত্যপন্থা তথা ইব্রাহীমের মিল্লাত, যা অনুসরণ করার জন্য আল্লাহ তাঁর সকল বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এতদ্ব্যতীত তিনি কারো কাছ থেকে অন্য কিছু কবুল করবেন না। আর এ সত্য পন্থাই হলো ইসলামের হাকীকত।
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“কেহ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবেনা এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত।” [আলে ইমরান, ৩:৮৫]
উপরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, শিরকে আকবার ও শিরকে আসগারের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেগুলো হল:
১. কোন ব্যক্তি শিরকে আকবারে লিপ্ত হলে সে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয়ে যায়। পক্ষান্তরে শিরকে আসগারের ফলে সে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয় না।
২. শিরকে আকবরে লিপ্ত ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে। পক্ষান্তরে শিরকে আসগারে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে গেলে চিরকাল সেখানে অবস্থান করবেনা।
৩. শিরকে আকবার বান্দার সমস্ত আমল নষ্ট করে দেয়, কিন্তু শিরকে আসগার সব আমল নষ্ট করেনা। বরং রিয়া ও দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃত আমল শুধু তৎসংশ্লিষ্ট আমলকেই নষ্ট করে।
৪. শিরকে আকবারে লিপ্ত ব্যক্তির জান-মাল মুসলমানদের জন্য হালাল। পক্ষান্তরে শিরকে আসগারে লিপ্ত ব্যক্তির জান-মাল কারো জন্য হালাল নয়। ] সহী ঈমান ও আকিদ্বা বর্ণনার পর খারাপ আকিদা কুপ্রথা ও কুসংস্কার এবং কিছু কবীরা গোনাহ যা প্রায়ই ঘটে থাকে যার দরুন ঈমানের সর্বাত্বক ক্ষতি হয় তার বর্ণনা করা যুক্তিসঙ্গত মনে করি। যেন জনগণ সেসব হতে বেঁচে থাকতে পারে।