দোয়া মুনাজাত আর কাকুতি-মিনতির অনন্য উদাহরণ
সেনা বিন্যাস পর্ব শেষ হলে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁবুতে এসে দাখিল হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জীবন সফরের একান্ত সহচর আবু বকর রা.। তাঁবুতে দাখিল হয়েই তিনি আল্লাহর কুদরতি পায়ে পড়ে গেলেন। কায়মনোবাক্যে তাঁর কাছে মনের আকুতি পেশ করতে লাগলেন। দোয়া আর মুনাজাতের মধ্যে তিনি বিভোর হয়ে গেলেন।
কারণ তিনি জানতেন, যদি মুসলিম বাহিনী এ যুদ্ধর জয়-পরাজয় তাদের বাহ্যিক আসবাব – উপকরণ আর জনবল ও মনোবলের মাপকাঠিতে বিচার করে তবে তার ফলাফল যুদ্ধের আগেই বলে দেওয়া যেত। সেটা বের করার জন্য আর যুদ্ধের ময়দানে নেমে শক্তি পরখ করে দেখার প্রয়োজন হত না। পৃথিবীর সমর ইতিহাসের প্রত্যেকটি দুর্বল ও লগু বাহিনীর প্রত্যেকটি সবল ও বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে স্বাভাবিক ফলাফল বের হয় এখানেও তাই হওয়াই যুক্তি-যুক্ত ছিল।
একইভাবে এই দুই বাহিনীকে যদি কোনো দাঁড়িপাল্লায় উঠিয়ে মাপা হতো তখনও নিশ্চিত ভাবেই মুশরিকদের পাল্লা ভারি হয়ে যেত বর মুসলমানদের পাল্লা শুন্যে উঠে যেত। তাই তিনি সর্বক্ষমতার আঁধার আর সব কিছুর কর্মবিধায়ক আল্লাহর কাছে আকুতি পেশ করলেন। যার আদেশের সামনে গোটা বিশ্ব চরাচরের কারও বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নাই। যার সিদ্ধান্তের বিপরীত করার দুঃসাহস গোটা সৃষ্টি জগতের কারও নাই।
যিনিই সকল নুসরাতের মালিক ; সকল সাহায্যের আধার। এ সুমহান মালিকের মহান দরবারে তিনি নিঃস্ব ও অসহায় মুসলিম বাহিনীর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সংখ্যায় যারা গনে দেখার মত ছিলনা। সমরাস্ত্র আর হাতিয়ারের বিবেচনায় যাদেরকে ফকির বললে মোটেও অত্যুক্তি হবেনা। তিনি দরগাহে ইলাহীতে নিবেদন করলেন, আল্লাহ!
আজ যদি এ দলটি ধ্বংস হয়ে যায় তবে এরপর গোটা পৃথিবীর বুকে আর কোনদিনও তোমার ইবাদত করা হবে না। এ সময় স্বীয় প্রতিপালকের সঙ্গে তাঁর গুঞ্জন আরও বৃদ্ধি পেল। গুণগুণিয়ে পবিত্র যবান মোবারক থেকে বেড়িয়ে এলো- হে আল্লাহ! তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর! হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর!! তাঁর দু’খানা তখন মহা মালিকের নুসরাতের আঁচল ছোঁয়ার এক অব্যর্থ প্রত্যাশায় সুনীল আসমান অভিমুখে ছুটে গেল। এক পর্যায়ে তাঁর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে গেল। আবু বকর রা. তখন তাকে শান্তনা দিতে লাগলেন মুনাজাতের উদ্বেলিত উত্তাপ আশ্বাসের শীতলতা দিয়ে খানিকটা শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
মুসলিম উম্মাহর যথার্থ পরিচিতি; তাঁর কেন্দ্রবিন্দু ও পয়গামের প্রকৃত অবস্থান
বদর প্রান্তেরের এক চরম নাযুক ও খতরনাক মুহুর্তে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ছোট দলটির এমন এক সংক্ষিপ্ত অথচ যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিলেন যেখানে আস্থা ও অস্থিরতা, উদ্বেগ ও অনুরাগ পাশাপাশি গলাগলি করছিল।। বস্তুত রাসূলের পবিত্র যবানে প্রদত্ত এটা ছিল এই উম্মাহর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ সংজ্ঞা।
গোটা পৃথিবীর তামাম জাতিগোষ্ঠীর মাঝে এ নতুন জাতি ও তাঁর নতুন পয়গামের বাস্তব ও সর্বাঙ্গীণ পরিচিতি। বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে তাঁর প্রকৃত মুল্যমান ও অবস্থান। আর তা হলো আল্লাহর প্রতি দাওয়াত এবং পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর ইবাদত। এটাই ছিল সেই ঐতিহাসিক বদর তামাম পৃথিবীর সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে মুসলিম উম্মাহর জাহাজের যেখানে নঙ্গর ফেলে।
রিসালাতের এ মহান নায়ক প্রদত্ত মুসলিম উম্মাহর এ সংজ্ঞার সত্যতা ও যথার্থতা প্রমাণে খুব বেশি সময় লাগেনি। সেইদিনই মরু আরবদের বদর প্রান্তরে অচিন্তিতপূর্ব এমন এক বিরল বিজয় বরণ করে নিয়েছিল এ উম্মাহকে যা তৎকালীন পৃথিবীর হাজার বছরের হাজার অভিজ্ঞতাকে নাকচ করে দিয়ে ভুল ও ভূয়া প্রমাণ করেছিল। যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল, সত্যিই এটাতে রূপায়িত হয়েছে এ উম্মাহর সম্পূর্ণ নির্ভূল ও যথার্থ ছবি।
এই দুই বিবাদীঃ তারা তাদের পালনকর্তাকে নিয়ে বিবাদ করে
অতঃপর রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁবু থেকে মুসলিম বাহিনীর নিকট বের হয়ে এলেন। প্রবল দিলাবরিতে তিনি তাদেরকে উচ্ছ্বসিত করে তুললেন। অপরদিকে কুরাইশ শিবির থেকে তখন তিন বীর বের হয়ে এলো- উতবা বিন রবিআ, তার সহোদর শাইবা বিন রবিআ, আর তার ছেলে ওলিদ বিন উতবা। উভয় শিবিরের ঠিক মাঝ বরাবর এসে তারা মুসলমানদেরকে সম্মুখ যুদ্ধের প্রতি আহবান জানাল। মুসলমানদের মধ্য থেকে তিনজন আনসার তাদের ডাকে সাড়া দিলেন। তারা বলল,
তোমরা কারা?
তারা বললেন: আনসার
তোমরা সম্মানিত লোক ; কিন্তু আমাদের কাছে আমাদের জ্ঞাতি ভাইদেরকে পাঠিয়ে দাও।
তখন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, উবাইদা ইবনে হারিস ( ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফ) দাড়িঁয়ে যান! হামযা দাড়িঁয়ে যান! আর আলী তুমিও উঠে সামনে এগিয়ে যাও!
তারা বলল, হ্যা সম্মানিত লোক! তোমাদের দিয়েই আমাদের কাজ হবে।
বয়োবৃদ্ধ উবাইদা, উতবার মোকাবেলা করলেন। হামযা এগিয়ে গেলেন শাইবার দিকে। আলী ছুটলেন ওলিদ বিন উতবার মোকাবেলার উদ্দেশ্যে। চোখের পলকে হামযা ও আলীর প্রতিপক্ষ দু’জন রণাঙ্গনে লুটোপুটি খেয়ে জনমের মত ঠান্ডা হয়ে গেল। ওদিকে উবাইদা ও উতবার মাঝে কয়েকবার আঘাত-পাল্টা আঘাত বিনিময় হলো। তখন হামযা ও আলী তাদের তরবারি নিয়ে উতবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকেও চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিলেন। উবাইদা রা. কে তারা বহন করে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে নিয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।
যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল
উভয় বাহিনী আরও কাছ থেকে কাছে এলো। মুশরিকরা মুসলমানদের আরও সন্নিকটে চলে এলো। এমন সময় রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, তোমরা ঐ জান্নাতের দিকে ছুটে যাও- যার প্রশস্ততা আসমান ও যমিনের সমান।
নোট: ইতিহাস জানার কোনো বিকল্প নাই। ইতিহাস থেকে আমরা অনেক কিছু জানি, অনেক কিছু শিখি। আবার অনেক মহা মানবের জীবন ইতিহাস পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর ফেলি। কিন্তু আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি যে, হয়তো আমরা সাময়িক মজা অনুভব করি কিন্তু তার থেকে কোনো ফায়দা আমাদের হচ্ছে না। কিন্তু আমরা এমন একজন মহা মানবের জীবন আলোচনা করেছি যা, ফায়দা থেকে খালি খালি নাই।
দ্বীন শিক্ষা ডট কমের পক্ষ থেকে আমরা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনি থেকে যুদ্ধের কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সংক্ষিপ্ত আকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যদি কোনো ধরনের ভূল-ভ্রান্তি হয় আশাকরি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
প্রিয় পাঠক আমরা রাসূলে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এত পরিমাণ লম্বা করিনাই যাতেকরে পড়ে আপনারা বিরক্ত হন, আবার এত পরিমাণ সংক্ষিপ্তও করিনাই যাতে বিষয়টি পড়ে মনের মধ্যে তৃপ্তি না আসে। সর্বদিকে বিবেচনা করেই আমরা লেখাটাকে মধ্যম পন্থায় লিখেছি। আরও জেনে খুশি হবেন যে, আমরা এই লেখাটা যেই গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছি আর তা হল;
আস সিরাতুন নববীয়্যাহ
মুল লেখক:
আবুল হাসান আলী নদবী র.