যখন তারা এসেছিল তোমাদের উপর আর নিচ থেকে
দিনের পর দিন একটানা পৃথিবীর ইতিহাসের বিশাল এক পরিখা খননের কাজ সুসম্পন্ন করে মুসলিম বাহিনী তখনো হাত ঝেড়ে খানিকটা বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারেনি; ঠিক সেই সময়ই মদিনার মাটিতে কুরাইশদের পদধ্বনি শোনা গেল। মদিনা সীমান্তের বাইরে অদূরে এসে শত্রু বাহিনী শিবির স্থাপন করল। তারা ছিল দশ হাজার সশস্ত্র যুদ্ধা। বনু গাতফানও তাদের মৈত্রী কওমগুলোকে নিয়ে কুরাইশদের সঙ্গে এসে মিলেছিল।
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। উভয় বাহিনীর মাঝে এবার নিশ্চিন্তে শুয়ে রইল অহর্নিশ কষ্টের ফসল সুবিশাল ও সুগভীর এক পরিখা। মদিনার ইয়াহুদী কবিলা বনু কুরাইযা শহরের নিশ্চিদ্র সুরক্ষার ক্ষেত্রে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে চুক্তিবদ্ধ ছিল । কিন্তু বনু নযীরের বিতারিত সরদার হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইযাকে এবার চুক্তিভঙ্গের জন্য কাতুকুতু দিতে লাগল।
কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর এই নতুন উম্মাহর জন্য এটা ছিল যিন্দেগীর নাট্যমন্চের এক আশ্চর্য ও চরম ঈমানী অগ্নিপরিক্ষা। জীমন ও মরণের দোলাচলে তারা তখন সমান তালে দুলছিল। হাজারো শঙ্কা আর আঙ্কা তাদেরকে চারদিক থেকে পেঁচিয়ে ধরেছিল। অনিরাপাত্তা আর ভীতির একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিল গোটা শহর জুরে। মদিনার আকাশে অলক্ষুণে শকুনগুলো কাটফাটানো কাউমাউ করে যাচ্ছিল।
এবার চতুর মুনাফিকদের পাখা গজাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে খোপের মধ্য থেকে বের হয়ে এবার তারা মুক্ত মনে আকাশে উড়াল দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বাধ সাধলেন সাহেবে রিসালাত রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি তাদের কান টেনে ধরলেন। মুসলমানদের মাঝে তারা যে সন্দেহ আর সংশয়ের যে বীজ বপন করে যাচ্ছিলেন তা হাতেনাতে ধরে ফেললেন।
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত সকল মুসলমানদের বিশেষকরে এই ছোট্টো উম্মাহর সকল শক্তি আর সামর্থ্যের উৎস আনসারদের উদ্বেগের কথা জানতে পারলেন। তখন তিনি মদিনার বার্ষিক উৎপাদিত খেজুরের এক তৃতীয়াংশ প্রদানের শর্তে বনু গাতফানের সঙ্গে সন্ধি করার মনস্থ করলেন। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইচ্ছা ছিল, আনসাররা আর এ ব্যাপারে কথা না বলুক।
কিন্তু আনসারদের আউস ও খাযরাযদের সরদার যথক্রমে সা’দ বিন মুআায ও সা’দ বিন উবাদা রা. রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্ত মতের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। তারা আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আমরা ও বনু গাতফান উভয় মাটির মুর্তির পুজা করতাম। আল্লাহ সম্পর্কে আমাদের কেউ কিছু জানত না।
তাকে আমাদের কেউ চিনত না। তখনো হাদিয়া কিংবা ক্রয় ছাড়া কোনোদিনও মদিনার একটি খেজুরও বনু গাতফানের কপালে জুটত না। আর এখন আল্লাহ তা’লা যখন আমাদেরকে ইসলাম ও আপনার হেদায়েত দ্বারা ইযযত ও সম্মান দান করেছেন তখন আমরা তাদেরকে ভয়ে আমাদের ধন-সম্পদ দিয়ে দিবো? আল্লাহর কসম! আমরা তাদেরকে কেবল আমাদের তরবারির আঘাতগুলোই দিবো। যতক্ষণ না আল্লাহ তা’লা আমাদের দুদলের মাঝে ফায়সালা করে দেন। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন।
ইসলাম আর জাহিলিয়াতের মুখোমুখি
রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুসলিম বাহিনী পরিখার অদূরেই এপারে তাদের তাঁবু স্থাপন করলেন এবং দিনরাত তার ওপর রাখছিলেন সতর্কদৃষ্টি। পরিখার অপর পারে শহর অবরোধ করে অবস্থান করছিলেন শত্রু বাহিনী। কিন্তু মাঝখানে পরিখা থাকার কারণে কোনো সংঘাত ও সংঘর্ষ ছাড়াই কেটে গেল বেশ কিছুদিন।
দুশমনের অশ্বারোহী বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে যখন এই বলে বিশাল ও সুপ্রশস্ত পরিখা দেখতে পেল তখন বিস্ময়ে তাদের চোখ ছানাবড় হয়ে গেল। এই অপ্রত্যাশিত অন্তরায় তাদেরকে ফেলে দিল মহা বিপদে।
বিস্ময়ে তারা চেচিয়ে উঠল: একী বিস্ময়কর পরিকল্পনা! কী বড্ড নতুন কৌশল!! অতঃপর পরিখা পারি দেওয়ার উপায় বের করার জন্য একে অন্যের কাছে পরামর্শ চাইতে লাগল।
একপর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নিল- পরিখার ঠিক কোন জায়গাটা তুলনামূলক বেশি সংকীর্ণ এবার আমাদেরকে সেটা খুজে বের করতে হবে। তাদের মধ্য থেকে বেশকিছু চঞ্চলপ্রাণ উদ্যমি সেনা ঘোড়ায় আঘাত করলে ঘোড়া দারুণ বেগ ও আবেগ নিয়ে মুসলমানদের মদিনার এপার চলে এলো। এ সকল যুদ্ধা পুরুষের একজন ছিল আরবের খ্যাতিমান পুরুষ আমার বিন আব্দুল উযযা। যাকে এক হাজার যুদ্ধার সমান মনে করা হত।
পরিখা পার হওয়ার পরে সে আপন ঘোড়া নিয়ে থেমে গেল এবং মুসলমানদের কাউকে তার মুকাবিলা করার জন্য আহবান করতে লাগল। মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে আলী রা. তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে এলেন এবং তার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, আমর তুমি কি আল্লাহর কাছে এই মর্মে ওয়াদাবদ্ব হতে পারবে যে, যদি কুরাইশের কেউ তোমার সামনে দুটি বিকল্প পেশ করে তবে তুমি তার যে কোনো একটিকে অবশ্যই গ্রহণ করবে।
আমর উত্তরে বলল, আলবত।
আলী রা. বললেন, তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি।
আমর বলল, আমার এগুলোর কোনো প্রয়োজন নাই।
আলী রা.বললেন, তবে এবার তোমাকে আমার মুকাবেলার জন্য আহবান করছি।
আমর বলল, আল্লাহর কসম! ভাতিজা, তোমাকে কোনোদিনও আমার হত্যা করার খায়েশ নাই।
আলী রা. বলল, আমি তোমাকে হত্যা করতে চাচ্ছি।
আমর তখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। উত্তেজনা আর প্রচন্ড আবেগে সে কাঁপতে লাগল। অতঃপর সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তার হাঁটু কেটে দিয়ে আলী রা. এর দিকে অগ্রসর হতে লাগল। উভয়ের মাঝে কয়েক দফায় ঘাত-প্রতিঘাত বিনিময় হল। শেষে আলী রা. এর বিদুৎ গতির অসির আঘাতে আমরের শির ভূলন্ঠিত হল। এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্যে ভেবাচেকা খেয়ে তার দুই সতীর্থ ঘোড়া নিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেল।