Monday, April 29, 2024
No menu items!
Homeসিরাতুন নবী (সা.)এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে

এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে

বীরে মাউনা

এর কিছুদিন পরেই ইসলামের ইতিহাসে দুঃখজনক ট্ট্যাজিডি সংঘটিত হয়েছিল। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জিন্দেগীতে দু’টি ঘটনা ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক ও বেদনাময়। বেদনারন প্রচন্ড চোটে তার দিল ও দিনাগ, মন ও প্রাণ মুষড়ে পড়েছিল। একটি কবিলার সরদার আমের বিন তুফাইল রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট তার কওমের লোকদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াতের কথা বলে সাহাবায়ে কেরামের একটি দল তার সঙ্গে পাঠানোর আবেদন জানায়।

তখন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বাহিনী মনোনীত করে পাঠিয়ে দেন। তারা ছিলেন সাহাবায়ে কেরামের শ্রেষ্ঠ একটি জামাত। যাত্রা অব্যহত রেখে যখন এ দলটি বীরে মাউনা নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন বনু সুলাইমের উসাইয়্যা, রিল, যাকওয়ান তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা তাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। সাহাবায়ে কেরাম তাদেরকে দেখে মোটেও ভয় পেলেন না।

তরবারি নিয়ে দুনিয়ার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা’লার ইবাদতকারী ছোট এ দলটি শিরক পূজারীদের ভারী দলগুলোর ওপর চালালেন পাল্টা আক্রমণ। এক পর্যায়ে কা’ব বিন যায়েদ রা. ব্যাতিত তাদের সবাই শহীদ হয়ে গেলেন। কা’ব বেচে যান এবং পরবর্তীতে খন্দক যুদ্ধের দিন শাহাদাত বরণ করেন।

শহীদের খুনে ইসলাম খুঁজে পেল খুনী

এ যুদ্ধে শহীদানের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাহাবী হারাম ইবনে মিলহান রা. তাকে হত্যা করেছিল জাব্বার বিন সালামা। শাহাদাতের পেয়ালায় অধর রেখে জীবনের সর্বশেষ যে বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল শহীদ সাহাবী হারাম ইবনে মিলহানের মুখ থেকে সেটি অমর করে দিয়ে গেল খুনী জাব্বার বিন সালামাকে। শহীদের আখেরী সেই বাক্যটিই খুনীর জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

এভাবে হারাম রা. এর খুনের মাঝে খুনী জাব্বার পেয়ে গেল জীবনের স্বপ্নময় সৈকতের ঠিকানা। পরবর্তী সময়ে জাব্বার রা. বলতেন, উহুদের দিন আমি এক মুসলিম সেনার দুই কাঁধের মধ্যবর্তী জায়গা লক্ষ করে বর্শা ছুড়ে দেই। পরে যখন আমি তার বক্ষ ভেদ করে বর্শার ফলা বের হতে দেখি তখন আমার কর্ণকুহরে তার আর্তচিৎকার এসে দারুণভাবে আঘাত হানে। কা’বার রবের শপত! আমি সফল হয়েগেছি!!

জাব্বার রা. বলেন, এটা আবার কেমন সফলতা তা ভেবে আমি সেদিন পরম বিস্মিত হয়েছিলাম। তাহলে সে কি সেদিন আমার হাতে নিহত হয়নি! পরে তিনি অন্যদের কাছে অনুসন্ধান চালালে তারা তাকে জবাব দেন যে, তার হাতে নিহত সেই সাহাবী নিজের মৃত্যুকে শাহাদাত হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। এবং এভাবে এক সময় তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তার হাতে নিহত সেই ব্যাক্তি সত্যিই সফল ছিল।

বনু নযীরের নির্বাসন

বীরে মাউনার দুঃখজনক ট্র্যাজিডিব থেকে একজন সাহাবী সৌভাগ্যক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল। পথিমধ্যে তিনি বনু আমেরের দুই ব্যাক্তিকে সন্দেহভাজন মনে করে হত্যা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বনু আমেরের সঙ্গে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চুক্তি থাকার কারণে তিনি তাদেরকে এই এই রক্তপণ পরিশোধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

যেহেতু ইয়াহুদীরাও রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। এ কারণে তিনি বনু নযীরের ইয়াহুদিদের কাছে সেই রক্তপণের টাকার জন্য আগমন করেন। বাহ্যিকভাবে তারা সানন্দে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই প্রস্তাব মেনে নিলো কিন্তু অভ্যন্তরে তারা পরিকল্পনা করতে লাগলো ইতিহাসের একটি ভয়াল জঘন্য কালো ষড়যন্ত্র।

অতঃপর তারা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের একটি ঘরের দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার অনুরোধ করল। ওদিকে তারা নিজেরা একে অপরকে বলতে লাগল, এমন স্বর্ণসুযোগ তোমাদের জীবনে দ্বিতীয়টি আর কখনো আসে কিনা বলা যায় না। তাই এই সুযোগ পূর্ণরূপে কাজে লাগাও। অলসভাবে এটা হাতছাড়া করে দিওনা। তাহলে পরে পস্তাতে হবে। তোমাদের কেউ ওপর থেকে মুহাম্মদের উপর একটি বড়সড় পাথর ছুড়ে ফেলুক। এতে করে আমরা তার হাত থেকে চিরদিনের জন্য রেহাই পাবো।

এ সময় রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তখন আবু বকর, উমর, আলী রা.সহ কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীও ছিলেন। ইয়াহুদিরা বিশ্বের অধিপতি আল্লাহ তা’লার এই প্রিয়তম সর্বশেষ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মানব চক্ষুর অন্তরালে বসে গোপনে সবধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এর সফলতা বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের কেন যেন তারা ভুলে গিয়েছিল যে, আসমান থেকে এক সত্তা পরম সচেতনতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তাদের সকল বাঁদরামি দেখে চলছেন। তিনি ছিলেন আসমান ও যমিনের একচ্ছত্র অধিপতি মহান আল্লাহ তা’লা।

আল্লাহ তা’লা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলেন। তখন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত সেখান থেকে উঠে কাউকে কিছু না বলে মদিনায় ফিরে এলেন এবং বনু নযীরের ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সাহাবায়ে কেরামকে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এভাবে চতুর্থ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে রিসালাতের আদালতে বিশ্বাসঘাতক ও গাদ্দার বনু নযীরের ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ রায় ঘোষিত হল। সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি বনু নযীরের ওপর অবরোধ আরোপ করলেন।

টানা ছয়দিন চললো এই অবরোধ। এভাবে একসময় আল্লাহ তা’লা তাদের হৃদয়ে প্রচন্ড ভীতি আর এক অজানা বাড়তি সঙ্কা ঢেলে দিলেন। তখন তারা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আবেদন করল যে, যদি তাদের জীবনের সুরক্ষার গ্যারান্টি নিশ্চিত করেন তবে তারা অস্ত্র-শস্ত্র ব্যাতিত অন্যান্য মালামাল নিয়ে মদিনা থেকে বহুদূরে কোথাও অভিবাসনে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সানন্দে তাদের আবেদন গ্রহণ করে নিলেন। এভাবে বছরের পর বছর ধরে মদিনার মাটিতে বসবাসরত ইয়াহুদীরা নিজেদের চিরাচরিত গাদ্দারির পরিণামে নিজেদের হাতে নিজেদের ঘর-বাড়ি ভেঙে উটের পিঠে তুলে এক অজানা পৃথিবীর অচেনা গন্তব্যে পা বাড়াল।

কুরআনুল কারিমে সূরা হাশরে আল্লাহ তা’লা বনু নযীরের সেই ঐতিহাসিক নির্বাসনের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন এভাবে:
তিনিই কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কাফির, তাদেরকে প্রথমবার একত্রিত করে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে বহিষ্কার করেছেন। তোমরা ধারণাও করতে পারনি যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর শাস্তি তাদের ওপর এমনদিক থেকে আসল, যার কল্পনাও তারা করেনি। আল্লাহ তা’লা তাদের অন্তরে ত্রাস সৃষ্টি করে দিলেন। তারা তাদের ঘর-বাড়ী নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। [সূরা হাশর:২]


নির্বাসিত এ সকল ইয়াহুদীর সিংহভাগই জড়ো হয়েছিল খাইবারে। এভাবে হিজাযের উত্তরাঞ্চলে আবারও নতুন করে একটি ইয়াহুদী দুর্গ গড়ে উঠেছিল। আর বাকিরা চলে গিয়েছিল সুদূর সিরিয়ার বিস্তৃত ভূখণ্ডে।
ইয়াহুদীদের রেখে যাওয়া ধন-সম্পদ গনিমতরূপে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে এলো। তিনি সেগুলোকে প্রাথমিক মক্কি মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের মাঝে বন্টন করে দিয়েছিলেন।

গযওয়ায়ে যাতুর রিকা

হিজরী চতুর্থ বছর রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদের দিকে একটি অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ছয়জন সাহাবায়ে কেরাম কে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেই একটি মরূদ্যানের লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত সাহাবী আবু মুসা আসআরী রা. ছিলেন একজন।

তখন মুসলমানগণ ছিলেন দারুণ দীনতা ও আর্থিক সংকটে। ফলাফলে পুরো বাহিনীতে একটি উট ছিল। তাই পুরো পথ তাদেরকে পায়ে হেঁটেই পারি দিতে হয়েছিল। ইতিহাসে এটি “যাতুর রিকা” অভিযান হিসাবে সবিশেষ প্রসিদ্ধ। কারণ এ অভিযানে প্রস্তর-ঘেরা যমিনে প্রলম্বিত সফরের ফলে সাহাবায়ে কেরামের পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এবং তারা সেই স্থানে রিকা তথা পট্টি বেঁধেছিলেন।


মুসলিম বাহিনী একেবারে দুশমনের মুখের কাছে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো উভয়ের মাঝে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। কেবল একে অন্যের মাঝে ভয় দেখাদেখি হয়েছিল। এটাই ছিল সেই ঐতিহাসিক অভিযান যাতে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম ” সালাতুল খাউফ ” নামায আদায় করে ছিলেন।

এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে

যাতুর রিকা অভিযান থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্রাম গ্রহণের নিমিত্তে যাত্রা বিরতি করলেন। তখন তিনি নিজেও বাবলা গাছের ছায়ায় শয়ন করলেন। তরবারিটি ঝুলিয়ে রাখলেন সেই গাছেরই একটি শাখায়।

সাহাবী জাবের রা. বর্ণনা করেন, তারা সবাই সফরের অনিঃশেষ ক্লান্তির অসহ্য পীড়নে অসহায় হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ডাক শুনে তাদের নিদ্রা ভঙ্গ হল। দৌড়ে তারা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গিয়ে দেখলেন এক বেদুঈন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পাশে শান্ত বদনে বসে আছে।

তিনি সাহাবায়ে কেরাম কে বললেন, সামান্য একটু বিশ্রামের উদ্দেশ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর সেই সুযোগে এই লোকটি আমার তরবারি হাতে নিয় আমার ওপর চেপে বসেছিল। অতঃপর যখন আমি ঘুম থেকে উঠলাম তখন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? আমি শুধু এতটুকু বললাম ‘আল্লাহ’। এখন তাকে তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছ। পরে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কিছু না বলে এমনিতেই ছেড়ে দিলেন।

যুদ্ধবিহীন গযওয়া

একই বছর শাবান মাসে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহুদের ময়দানে আবু সুফিয়ানকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিমিত্তে বদর প্রান্তরে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি বিশাল সংখ্যক সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ আটদিন একটানা মক্কি বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকেন।

আবু সুফিয়ান তার অঙ্গিকার পালনার্থে মক্কা থেকে বেরিয়ে এসেছিল বটে, কিন্তু দুস্তর মরুসাগরের কিছু পথ পাড়ি দেওয়ার পরে তার শক্তি ও সাহস সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়ে। কয়েক মাইল যেতে না যেতেই তার হৃদয় শুকিয়ে ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে তার বাহিনীর সৈন্যদের ফিরে যেতে প্ররোচিত করে। তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করে, অর্থনৈতিকভাবে তোমরা আজ দরুন সংকটের মুখে রয়েছ। তাই এখন ফিরে যাওয়াই তোমাদের জন্য কল্যাণের একমাত্র পথ। এভাবে দীর্ঘ আটদিন পর মুসলিম বাহিনী মদিনায় ফিরে আসে।

এর কয়েক মাস পরে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুওমাতুল জান্দালের দিকে একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ ব্যতিরেকেই সাহাবায়ে কেরামের দলটি মদিনায় ফিরে এসেছিল।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments