Monday, April 29, 2024
No menu items!
Homeসিরাতুন নবী (সা.)নবীর জন্য ভালবাসা ও আশ্চর্য আত্মনিবেদন

নবীর জন্য ভালবাসা ও আশ্চর্য আত্মনিবেদন

এক মুমিন নারীর ধৈর্য আর অবিচলতার বিস্ময়কর কারিশমা

সাফিয়্যা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব রা. ছিলেন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচা হামযা রা. এর বোন। যুদ্ধ শেষে তিনি ভাইকে এক পলক দেখার জন্য এগিয়ে এলেন। প্রাণ প্রিয় ভাইটিকে একটিবার দেখার জন্য যখন তিনি ছুটে আসছিলেন তখন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ছেলে যুবাইর ইবনুল আওয়্যাম রা. কে নির্দেশ দিলেন, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও! সে যেন তার ভাইয়ের বিকৃত লাশের করুণ দৃশ্য দেখতে না পারে।

তখন যুবাইর রা. মাকে বললেন, আম্মিজান! রাসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইচ্ছা আপনি ফিরে যান। তিনি বললেন কেন? আমি সংবাদ পেয়েছি আমার ভাইয়ের অঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। কিন্তু এটা তো আল্লাহর জন্য হয়েছে। তাই আমি তাঁর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদানের আশা ও সবর ইখতিয়ার করবো ইনশাআল্লাহ! অতঃপর তিনি এসে ভাইকে দেখলেন এবং তাঁর জন্য মাগফিরাত কামনা করলেন। অতঃপর রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে তাকে উহুদের মাটিতেই দাফন করা হয়। আজও তার কবর সেখানে দেড় হাজার বছরের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।

মুসআব বিন উমাইর রা. ও শহীদানের দাফন

উহুদ যুদ্ধের শহীদানের মধ্যে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী সাহাবী মুসআব বিন উমাইর রা. ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পুর্বে যই মুসআব ছিলেন কুরাইশের নামি-দামি, সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী জোয়ানদের একজন; উহুদের প্রান্তরে সামান্য একটি চাদর নিয়ে আজ তিনি ওপারের পথে যাত্রা করলেন। চাদরটি দিয়ে তার মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত আবার পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যেত। পরিশেষে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেন, এটা দিয়ে তার মাথা ঢেকে পায়ের উপর ইযখির ছড়িয়ে দাও।

রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে উহুদের দিন প্রতি দুজন শহীদ কে এক টুকরো কাপড়ে কাফন দেওয়া হয়েছিল। কাফন সম্পন্ন হলে তিনি বলেছিলেন, তাদের মধ্যে কোরআন কার বেশি মুখস্থ? অতঃপর যখন ইঙ্গিতে একজনকে দেখিয়ে দেওয়া হত তখন তাকে আগে কবরে নামাতেন। শহীদানের দাফন শেষে তিনি তাদের শিয়রে দাড়িয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে ইরশাদ করলেন- কেয়ামতের দিনে আমি তাদের জন্য সাক্ষী থাকব। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে উহুদের শহীদানকে তাদের খুন রঞ্জিত কাপড়েই দাফন করা হয়েছিল। তাদেরকে গোসল দেওয়া হয়নি। তাদের ওপর জানাজা নামাযও হয়নি।

নবীজীর জন্য ভালবাসা

মুসলমানরা মদিনায় ফিরে আসার সময় পথে বনু দিনারের এক মহিলার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটে। উহুদ যুদ্ধে সে মহিলার স্বামী, বাপ ও বেটা শহীদ হয়েছিল। যখন তার কাছে তাদের শাহাদাতের সংবাদ দেওয়া হলো তখন তিনি বললেন, প্রথমে আপনারা আমাকে আমার নবীজীর অবস্থা বলুন! তার জবাব দিলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি ভালো ও সুস্থ আছেন। তিনি বললেন আপনারা আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন! যখন তারা তাকে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে নিয়ে গেলেন তখন তিনি বললেন, আপনি যখন সুস্থ আছেন তখন পেরেশানির আর কিছুই নেই।

আশ্চর্য আত্মনিবেদন

উহুদ প্রান্তর থেকে বের হয়ে মক্কী বাহিনী তখনো পথেই ছিল, এ সময় তারা একে অপরকে তিরস্কার করে বলতে লাগলো, তোমরা তাদের কিছুই করতে পারনি। তোমরা তাদের তরবারির ধার শুধু পরখ করে দেখোছো এরপর কিছু না বলেই আবার ছেড়ে দিয়েছ। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তৎক্ষনাৎ তিনি পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিলেন।

মনে রাখতে হবে এটা এমন এক দুঃস্বময় যখন উহুদ যুদ্ধে আহত মুসলমানদের ক্ষতস্থান থেকে তখনো দেদারসে লালা খুন বয়ে চলছিল। আহতদের গোঙানি তখনো মন্ধ হয়েছিল না। এতকিছুর পরেও পরের দিন রবিবার রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক ঘোষকের কন্ঠে ধ্বনিত হল এক গুরুগম্ভীর ঘোষণা; তাতে মুসলিম মুজাহিদদের দুশমনের পশ্চাদ্ধাবনে বের হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হল; যারা গতকাল উহুদের ময়দানে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছিল কেবল তারাই যেন আজকের অভিযানে বের হয়।

ঘোষকের আওয়াজ মুহুর্তে মধ্যে মদিনার অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়ল বাতাসের বেগে। আহত সাহাবায়ে কেরাম চোখের পলকে তাদের সকল ব্যাথা আর বেদনার কথা ভূলে গেলেন। মুহুর্তে দাড়িয়ে গেলেন নবীজীর সঙ্গে অভিযানে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। একজনও পেছনে পড়ে রইলেন না। মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে আট মাইল দূরে হামরাউল আসাদ নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রা বিরতি করে।

সেখানে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম কে নিয়ে সোম, মঙ্গল ও বুধবার এই তিনদিন অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। তখন তার মুখে ছিল কুদরতে বারী তা’লার প্রশংসা। মুসলমানদের জীবনে এ চরম খতরনাক ও নাযুক মুহুর্তেও রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ডাকে তাদের সরব সাড়া সত্যিই পৃথিবীর ইতিহাসে এক পরম বিস্ময়কর ঘটনা ছিল। এ কারণে এটা শাশ্বত হয়ে পৃথিবীর বুকে চিরদিন টিকে থাকার যোগ্য ছিল। তাই তো আল্লাহ তা’লা কুরআনে কারীমে এটাকে অবিনশ্বর করে রেখেছেন এভাবে:


যারা আহত হয়ে পড়ার পরও আল্লাহ এবং তার রাসূলের নির্দেশ মান্য করেছে, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও পরহেজগার, তাদের জন্য রয়েছে মহান সাওয়াব। যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবিলা করার জন্য লোকেরা সমাবেশ করেছে বহু সাজ-সরঞ্জাম; তাদের ভয় কর। তখন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হয়ে যায় এবং তারা বলে, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট; কতইনা কামিয়াবিদানকারী।

অতঃপর ফিরে এলো মুসলমানরা আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে।, তাদের কিছুই অনিষ্ট হলনা। তারপর তারা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হল। বস্তুত আল্লাহর অনুগ্রহ অতি বিরাট। এরা যে রয়েছে, এরাই হল শয়তান। এরা নিজেদের বন্ধুদের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করে। সুতরাং তোমরা তাদের ভয় করনা। আর তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক, তবে আমাকে ভয় কর। [ সূরা আলে ইমরান : ১৭২-১৭৫]
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে শাহাদাত বরণ করেন সত্তর জন। যাদের অধিকাংশই ছিলেন আনসারী সাহাবী। আর মুশরিকদের নিহত হয়েছিল বাইশজন।

মুসলমানদের জন্য একটি শাশ্বত শিক্ষা

উহুদ যুদ্ধে দুর্বিপাক আর প্রতিকূলতার যে ঝড় মুসলমানদের সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল তা ছিল মুলত গোনাহের ক্ষমা আর একটি শাশ্বত শিক্ষার মাধ্যম। আজীবন যে দলটি একের পর এক বিজয়ের মুখ দেখতেই থাকে, জীবনের প্রতিটি ময়দানে যারা জয়ের নেশায় মাতাল থাকে, টানা সমর সফলতার মিষ্টতায় সুখ স্বপ্নে বিভোর যারা, পরাজয়ের বিস্বাদ যারা কখনো জিহ্বায় ছুঁয়েও দেখেনি।

যারা ভোগ করেনি জীবন যুদ্ধের প্রকৃত প্রতিকূলতা- তাদের ব্যাপারে কোনোদিনও আস্থা পোষণ করা যায়না। জীবন যুদ্ধের প্রকৃত ময়দানে তাদেরকে নিয়ে কোনোদিনও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে সুন্দর একটি সপ্ন দেখা যায়না। প্রতিকূলতার তুফানের মুখে তাদেরকে নিয়ে দাড়িয়ে থাকার আশা করা যায় না। কারণ কোনোদিন যদি তারা সেই প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তখন এটা মেনে নেওয়া তাদের জন্য বড় কঠিন হয়ে দাড়ায়; বরং তাদের ঈমান আর বিশ্বাসের ভিতরেই সেদিন নড়বড়ে আর টাল-টালায়মান হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন: অতঃপর তোমাদের উপর এলো শোকের উপর শোক, যাতে তোমরা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বস্তুর জন্য দুঃখ না কর যার সম্মুখীন হচ্ছো সেজন্য বিমর্ষ হয়োনা। আর আল্লাহ তোমাদের কাজের ব্যাপারে অবগত রয়েছেন। [ সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৩]


এ কারণেই প্রজ্ঞাময় কুদরতে বারী তা’লা এ যুদ্ধে মুসলমানদের আত্মাকে অনাগত ভবিষ্যতেের জন্য আগ থেকেই প্রস্তুতি পর্ব সেরে রেখেছিলেন। তাদেরকে তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যু ও তার শাহাদাতের সংবাদ শুনেও ধৈর্য আর অবিচলতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তৈরী করেছিলেন। যাতেকরে তার জীবদ্দশায় ও তার ওফাতের পরে তারা এ দিনের উপর চিরদিন অবিচল থাকে। এর দিকে বিশ্ব মানবতাকে দাওয়াত দেওয়ার কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যায়।

তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে যেন তারা আজীবন সত্য ও বিশ্বস্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে যেন তারা কখনো কোন ধরণের ব্যর্থতা কিংবা নৈরাশ্যের প্রমাণ না দেয়। তার ওফাতের পরে তারা ভীত হয়ে অলস্যভরে যেন এ পথ থেকে ছিটকে না পড়ে।

ঠিক এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন:
আর মুহাম্মদ একজন রাসূল বৈ তো নয়! তার পুর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েগেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যু বরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুত কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবেনা। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করেন।[ সূরা আলে ইমরানঃ১৪৪ ]

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments