Sunday, November 17, 2024
No menu items!
Homeসিরাতুন নবী (সা.)সন্ধি থেকে বিজয়ের পথে

সন্ধি থেকে বিজয়ের পথে

কখনো তোমরা কোন জিনিস পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য উপকারী

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় ফিরে এলেন, তখন মক্কা থেকে আবু বশির উতবা নামক এক ব্যক্তি রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে হাজির হলো। এদিকে কুরাইশরা তার খোঁজে দুই ব্যক্তি কে পাঠালো। তারা এসে বলল, আপনি এখন চুক্তি অনুযায়ী কাজ করুন। যরাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বসিরকে দুই ব্যক্তির হাতে তুলে দিলেন।

তারা তাকে নিয়ে চলতে শুরু করলো। কিন্তু সেখান থেকেও সে পালায়ন করে সাইফুল বাহার নামক এলাকায় গিয়ে থাকতে লাগল। ইতোমধ্যে আবু জান্দাল বিন সোহাইলও কুরাইশদের হাত থেকে পালিয়ে আবু বশিরের সঙ্গে মিলিত হল। অবস্থা এমন হলো, এখন পুরা এদের মধ্য থেকেই যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, সেই আবু বশিরের সঙ্গে এসে মিলিত হচ্ছিল ‌ এভাবে তাদের একটি ছোটখাটো দল হয়ে গেল ‌ অতঃপর কুরাইশদের কাছ থেকে সিরিয়াগামী যেকোনো কাফেলা সংবাদ পৌঁছামাত্রই তারা সেই কাফেলার গতিরোধ করে তাদের হত্যা করত আর তাদের মালামাল লুন্ঠন করে নিয়ে যেত।

শেষমেষ কুরাইশরা বাধ্য হয়েই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বরাবর মদিনায় পত্র প্রেরণ করে তাকে আল্লাহ ও আত্মীয়তার বন্ধনে দোহাই দিয়ে বলল, এখন থেকে আমাদের যে লোক আপনার কাছে চলে যাবে, সে নিরাপদ; তাকে আর ফিরিয়ে দিতে হবেনা।

সন্ধি থেকে বিজয়ের পথে
হুদাইবিয়ার সন্ধির পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে যে জিনিসটি বড় স্পষ্ট হয়ে সচেতন পাঠকের কাছে ফুটে উঠে তা হল, যদিও হুদায়বিয়ার সন্ধির ক্ষেত্রে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর বিনয় ও নম্রতা ছিল অভাবনীয়; যদিও তাকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে কুরাইশদের সকল বেয়াড়াপনা কে মেনে নিতে হয়েছিল;

মুসলমানদের জন্য বাহ্যত পরাজয় মুলক এই সন্ধি যদিও সহ্যসীমার বাইরে ছিল, কিন্তু এই সকল পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ আমাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, এই সন্ধি ছিল ইসলামের বিশ্ব বিজয়ের এক নয়া দিগন্তের উদ্বোধন। এরপর ইসলাম গোটা জাজিরাতুল আরবে এতটা বেগ আর আবেগ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, যা ইতিপূর্বে কোনদিন কারো চোখে পড়েনি। এই পথে হেঁটে হেঁটেই একদিন মক্কা বিজয় সম্ভব হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল কিসরা, কায়সার, মুকাওকিস আর নাজাশী সহ পৃথিবীর বড় বড় রাজা-বাদশাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরা। মহান আল্লাহ তাআলার ঘোষণা চিরসত্য:

অর্থাৎ তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয়ে তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জানো না। সূরা বাকারা 116

এই ছন্দের অন্যতম ফলাফল ছিল এই যে, এর মাধ্যমে কুরাইশরা মুসলমানদের মর্যাদা ও ইসলামের প্রতিপত্তি স্বীকার করে নিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে একটি শক্তিশালী জামায়াত ও গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সবকিছুর আগে বেড়ে এই সন্ধির সর্বোচ্চ ফলাফল ছিল যুদ্ধবিরতি, শান্তি ও নিরাপত্তা। এই সন্ধির মাধ্যমে মুসলমানরা এমন সব যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে খানিকটা আরাম পেয়েছিলেন যার কোন আউয়াল আখের ছিল না। তাই এবার তাড়াশে যুদ্ধ-বিগ্রহ বাদ দিয়ে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতের কাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। একটি শান্ত ও সুন্দর পরিবেশে দ্বীনের দাওয়াত চলতে লাগলো অবিরাম অব্যাহত গতিতে।

পাশাপাশি এই সন্ধি মুসলমান ও মুশরিকদেরকে সমান ভাবে একে অপরকে নতুন করে চেনা ও জানার সুযোগ করে দিয়েছিল। তখন মুশরিকরা মুসলমানদের সান্নিধ্যে এসে ইসলামের সৌন্দর্য জানার সুযোগ লাভ করেছিল। সভ্যতা-সংস্কৃতি আখলাক-চরিত্র মানবীয় গুনাবলীর ভুবনে ইসলাম যে বিস্ময়কর সৌন্দর্য পৃথিবী কে উপহার দিয়েছিল এগুলো দেখে তারা মুগ্ধ ও মোহিত হচ্ছিল।

শত বেয়াড়াপনা ঘাড়তেরামি সত্বেও মুশফিকদের কাছে একটি বিষয় কিন্তু ঠিকই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, কেবল ইসলামের শিক্ষা আর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সান্নিধ্যই মুসলমান নামক এই নতুন জাতিগোষ্ঠীকে তাদের সকলের থেকে ভিন্ন একটি স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। তাদেরকে একটি নতুন স্বাধীন জাতিতে পরিণত করেছে। মানবতাকে এমন করে সাজিয়েছে যা ইতিপূর্বে কোনদিন সাজানো হয়নি। আর এগুলো তাদেরকে ইসলাম চিনতেও বুঝতে আর তার প্রভাব স্বীকার করে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

ফলে দেখা গেল, হুদায়বিয়ার সন্ধির মাত্র এক বছর যেতে না যেতেই এত বিশাল সংখ্যক লোক ইসলামের মধ্যে দাখিল হয়েছিল পূর্বের সর্বমোট 15 বছরেও যত লোক মুসলমান হয়নি। মক্কা বিজয় হয়েছিল এই ঘটনার বাহিরে।
ইমাম ইবনে শিহাব জহুরীর রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইতোপূর্বে কেবল যুদ্ধ হতো এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষের মোকাবেলা করতে। কিন্তু একে অপরকে কাছ থেকে চেনা ও জানার সুযোগ কোনদিন পাইনি। কিন্তু এই সন্ধির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সেই অবস্থাতেই তৈরি হয়ে গেল।

ফলে এখন উভয়পক্ষ একে অপরের কাছে আসতে লাগল। আলোচনা-পর্যালোচনা হতে লাগলো। ফল দাঁড়ালো, যে কেউ ইসলাম সম্পর্কে নিজের বিবেকে মোটামুটি একটি ধারণা পেতে তখন আর দেরি না করেই ইসলামে দাখিল হয়ে যেত। ফলাফলে সেই দুই বছরে যে পরিমাণের লোক ইসলামে দাখিল হয়েছিল, তা ইসলামের জীবনের বিগত সবগুলো বছরে ইসলাম গ্রহণকারীদের সমান কিংবা বেশি ছিল।

ইবনে হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যুহরীর কথার স্বপক্ষে দলীল হল, জাবের রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার সময় চৌদ্দশ সাহাবীকে নিয়ে বের হয়েছিলেন। আর মাত্র দুই বছর পরে মক্কা বিজয়ের সময় সেখানে দশ হাজার সাহাবী নিয়ে বের হয়েছিলেন।


পাশাপাশি মক্কায় এখনো যে সকল দুর্বল ও অসহায় মুসলমান রয় গিয়েছিলেন, তারা ওই সন্ধির মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তার সনদ পেলেন। আবু জান্দাল এর হাতে কুরাইশের অনেক লোক মুসলমান হয়েছিল। ফলে দিকে দিকে ইসলামের দাওয়াত ও প্রচার-প্রসার ঠেকিয়ে রাখা এখন কুরাইশদের জন্য পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।


এই সকল মুসলমান আবু বশিরের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন। ততদিনে তিনি ইসলামের এক বিশাল মারকাজে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। কুরাইশরা তখন তার ব্যাপারে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সঙ্গে কথা বলল। তারা নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে অনুরোধ জানালো যেন তিনি তাদেরকে ডেকে মদিনায় নিজের কাছে নিয়ে নিন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাই করলেন। এভাবে তারা মক্কার সংকীর্ণতা থেকে আজীবনের জন্য মুক্তি ও নাজাত পেলেন। বস্তুত এ সবকিছুই ছিল সেই হুদায়বিয়ার সন্ধির সুফল ও এক বিশাল বিজয়ের পূর্বাভাস।


এই সন্ধির আরো একটি ফলাফল ছিল এই যে, এর মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত আরবের যেসকল কবিলা ইসলামে দাখিল হয়েছিল না তাদের অন্তরেও ইসলাম সম্পর্কে এখন একটি সুন্দর ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। ইসলামের ইজ্জত ও সম্মান তাদের হৃদয় বসে গিয়েছিল। ফলাফলে এমনিতেই দাওয়াতের একটি সুন্দর পরিবেশ এখন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। যার জন্য এখন আবার নতুন করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর ইসলাম

এই হুদাইবিয়ার সন্ধি অসংখ্য বন্ধ হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিয়েছিল। যে এভাবে বীর বাহাদুর সাহাবী খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইসলামে দাখিল হয়েছিলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর হাত ধরে মুসলমানদেরকে সিরিয়ার বিজয় দান করেছিলেন।


এই সময় আরো মুসলমান হয়েছিলেন মক্কার আরেক বীর সন্তান সাহাবী আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। আল্লাহ তাআলা পরবর্তীতে তার হাত ধরে মিশরের বিজয় দান করেছিলেন। তারা উভয়ে হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে দরগাহে সালাতে হাজির হয়েছিলেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments