Saturday, April 27, 2024
No menu items!
Homeতালেবুল ইলমের পাতাদাওরায়ে হাদীস পরীক্ষার্থীদের জরুরী নির্দেশনা। পর্ব-১

দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষার্থীদের জরুরী নির্দেশনা। পর্ব-১

-মুফতী রফিকুল ইসলাম আল-মাদানী

এইতো কয়েকদিন পরেই আসছে ১৪৪২ হিজরী দাওরা হাদীসের সমাপনী পরীক্ষা। “আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ” -এর তত্ত্বাবধানে দেশের বৃহত্তম ৬ বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এই পরীক্ষা। দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষা হলো দরসে নেজামীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই সনদ মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি লাভ করায় এ পরীক্ষার গুরুত্ব আরো বেড়েছে। তাই এ পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের বর্তমানে অনেক চাপে থাকতে হয়। যদিও তারা মেশকাত জামাত পর্যন্ত অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে, তবু দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষাটা বর্তমানে বেশি আলোচিত। সবার মধ্যেই এ পরীক্ষা নিয়ে একটা আগ্রহ জমেছে। যখন হাইযআতুল উলয়ার ফলাফল প্রকাশ হয়, সেদিন অনেক পত্রিকার শিরোনাম হয় দাওরা হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে। ফেসবুকে হয় জমজমাট পর্যালোচনা। একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ থাকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলোতে। আর মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের তো আনন্দের অন্ত নেই।
এই তো আর মাত্র কয়টা দিন, সব কিছু ভুলে ভালোমত পড়ালেখা করো। এটা তোমাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। এ পরীক্ষাটা খুব ভালো করে দাও তোমরা। তোমার নিজের জন্য, বাবা-মার জন্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এর জন্য, মাদ্রাসার সুনাম এর জন্য এবং পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলাকে রাজি করার জন্য। আমাদের পড়ালেখা আল্লাহর জন্য, সবকিছু আল্লাহর জন্য। পরীক্ষা হল সত্যিকার পড়ালেখা প্রমাণ করার মাধ্যম। প্রতিযোগিতামূলক পড়ালেখার অন্যতম পদ্ধতি।

ভুলে যেয়ো না:-

আমাদের আসল পরীক্ষা হল পরকালের পরীক্ষা। মহান প্রভু কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন,

“যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে ভাল আমল করে। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।
( সুরা মূলক-২)
পরকালের পরীক্ষায় যে যত ভালো ফলাফল অর্জন করবে, সে তেমন মহাপুরস্কার লাভ করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“যারা ভালো করেছে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম বিনিময়। আরো অতিরিক্ত।
( সূরা ইউনুস-২৬)
পরকালের পরীক্ষায় যে অকৃতকার্য হবে তার হতাশা ও অশান্তির শেষ নেই। ওই পরীক্ষা দ্বিতীয়বার পুনরায় দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই।
সাবধান! আল্লাহ তা’আলাকে তোমরা ভুলে যেওনা। ভুলে যেওনা পরকালকে। পরীক্ষার প্রস্তুতি যত কঠিন হোক না কেন, নামাজ, দু’আ ও সুন্নতী আমলে যেন কোনো অবহেলা না হয়। সময়মতো নামাজ আদায় করা চাই। ইবাদত করা চাই মনোযোগ দিয়ে, সাহায্য চাও আল্লাহ তা’আলার কাছে। তিনিই সবকিছুর মালিক।

ভয় নেই:-

সুদৃঢ় ও মনোবল নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। পরীক্ষা কক্ষেও পুরো মনোবল নিয়ে পরীক্ষা সম্পাদন করতে হবে। নিজের সাহস আর মনোবল হবে সফলতার প্রথম চাবি। মনে রাখবে, পরীক্ষা ভয়ের কিছু নয়; পরীক্ষা জীবনের উন্নতির সোপান, যা ভালোভাবে অতিক্রম করার মাধ্যমেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাই ভয় না পেয়ে জয় করব মাস্টার্স সনদটাকে। মন ভালো রেখে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে পরীক্ষা দাও। ফল ভালো হবেই ইনশাআল্লাহ!

শরীর ঠিক তো তুমি ফিট:-

সময়ের কাজ সময়ে করলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়। জীবনের পহেলা সবক “আজকা কাম কাল পর নাহ ঢাল”। তাই পড়াশোনার রুটিনটায় সারা বছরই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। এখন পরীক্ষার আগে খাওয়া-দাওয়া ও ইবাদত- বন্দেগী ভুলে পড়াশোনা দরকার নেই। রাত-দিন এর সময়সূচী অবশ্যই ভাগ করে নিতে হবে। তবে বিশ্রামের জন্য সময় রাখবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে। তুমি যদি এখন বেশি বেশি রাত জেগে পড়ালেখা করো, তাহলে পরীক্ষার রাতে বা আগের দিন ঠিকমতো রিভিশন দিতে পারবে তো…? অহেতুক দুশ্চিন্তা বাদ দিতে হবে। পড়া, খাওয়া-ঘুম এবাদত-বন্দেগী সবই করতে হবে। তবে অবশ্যই নিয়মমতো, নেজাম মতো। মনে রাখবে, শরীর ঠিক থাকলেই তুমি ফিট।

পরীক্ষার আগের দিন করণীয়:-

পরীক্ষার আগের দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটা আসার আগেই তুমি পেয়ে যাবে প্রবেশপত্র ও রেজিস্টেশন কার্ড। এগুলোর কয়েকটি ফটোকপি করে রাখবে। পরীক্ষার দিন কী কী নিয়ে যেতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করে সেগুলো গুছিয়ে নেবে। যেমন প্রবেশপত্র ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড এর মূলকপি, তিন-চারটি কলম, লম্বা স্কেল, ঘড়ি ইত্যাদি একটি স্বচ্ছ ফাইলে ভরে রাখবে। এমন কলম নেবে, যেগুলো দিয়ে দ্রুত লেখা যায়। তোমার জানা মতো কয়েকটি ভালো কলম আগে থেকেই কিনে নেবে। এগুলো দ্বারা কয়েক পৃষ্ঠা করে লিখে কলমগুলো তোমার সুবিধামতো চালু করে নেবে। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আগে থেকে কিনে রাখবে। প্রথম দিন যে বিষয়ে পরীক্ষা হবে তা আগের দিন ও রাতে যথাসাধ্য রিভিশনের চেষ্টা করবে। তবে পরীক্ষাকালীন সময় অতিমাত্রায় রাত জাগবে না। কোন কিছুই পরিমাপের বেশি খাবে না। পেটে সমস্যা হয়, এমন খাবার অবশ্যই পরিহার করবে।

ভালো নম্বর পাওয়ার সহজ অনুশীলন:-

ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মূল কিতাব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। প্রচলিত গাইড বইয়েরও সহযোগিতা নিতে হবে। তবে এর উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। আর লেখাপড়া ও উপস্থাপনা সুন্দর হওয়া তো আকর্ষণীয় উত্তরপত্রের জন্য একান্ত জরুরী বিষয় আছেই।

এক. মূল কিতাব আগে আয়ত্ত করতে হবে:-

মূল কিতাব যথাযথভাবে আয়ত্ত করা, অনুবাদ জানা, শাব্দিক বিশ্লেষণ ও হাদীসের ব্যাখ্যা অনুশীলন করা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষায় পাসের হার জন্য নয়, জীবনের প্রয়োজনে মূল কিতাবে বদখল থাকা আবশ্যক। মূল কিতাবে পূর্ণ জ্ঞান ছাড়া জীবনে কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারবে না। তবে মূল কিতাব সহজে আয়ত্ত জন্য কিছু কলাকৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।
মূল কিতাব আয়ত্ত করাকে একটি কঠিন বা দুর্বোধ্য বিষয় মনে করা হয়। একটি অজানা আশঙ্কায় দিন -রাত অতিবাহিত করতে হয়। নিজের প্রতি আস্থার জায়গায় চিড় ধরে। কিন্তু আমি তোমাদের বলব, কোনভাবেই আশাহত হবেনা। বরং স্বীয় লক্ষ্যে অবিচল থাকবে। এক মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করে মনের গহীনে প্রবেশ করে নিজেকে প্রশ্ন করো :
মূল কিতাব কে ভয় না পেয়ে জয় করার জন্য ভালবেসে কতটা সময় দিয়েছো?
শুধু পরীক্ষায় ভালো করার জন্য কিতাব পড়ো, নাকি রাসূলের (সা.) হাদীস জানার জন্য বুঝে পড়ো?
মূল কিতাব আয়ত্ত করার জন্য কী কী উপায়- উপকরণ অবলম্বন করেছো?
উপরের প্রশ্নগুলোর ছাড়াও অনেক প্রশ্ন হতে পারে। কোন প্রশ্নের উত্তর- ” না” বোধক হলে বুঝতে হবে, হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পানির যেমন বিকল্প নেই, তেমনি কোনো বিষয়ে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য স্থির মনোবল, বিষয়টির প্রতি ভালোবাসা- আগ্রহ ও কঠোর অনুশীলনের বিকল্প আজও সৃষ্টি হয়নি।
হাইআতুল উলয়ার বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে সব বিষয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এত দিনে তোমরা পাঠ্যবইয়ের সব অংশ শেষ করেছো নিশ্চয়ই। কোন কিতাবের কোন বিষয় বাকী থাকলে তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে নাও। জেনে রেখো, কোন বিষয়ে পরীক্ষা খারাপ হলে মোটের উপর ফলাফল ভালো হয় না। প্রতিটি বিষয়ে ভালো হলেই সামগ্রিক ফল ভালো হয়। তাই সব বিষয়ের ক্ষেত্রেই সময় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করো।
হাদীসের কোন একটি কিতাব শুরু-শেষ ভালোভাবে পড়ে নিলে সব বিষয়ে সম্যক ধারণা হবে। এক্ষেত্রে “সুনানে তিরমিযী” পরিপূর্ণ একটা রিভিশন দেওয়া দরকার। এছাড়া কিতাবুল ঈমান ‘সহীহ বুখারী’ ও ‘সহীহ মুসলীম’ থেকে, কিতাবুল ইলম, ওহী ও মাগাজী ‘সহীহ বুখারী’ থেকে, কিতাবুল উজহিয়্যা, জাবাইহ ও জিহাদ ‘আবু দাউদ’ থেকে, আল ইতেসাম বিল কিতাব ওয়াসসুন্নাহ্ ‘ইবনে মাজাহ’ থেকে, এবং কিতাবুল বুয়ূ ও কিসাস, হুদুদ, শাহাদত ‘সহীহ মুসলিম’ দ্বিতীয় খন্ড থেকে, ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে।
আর শামায়েলে তিরমিযী, কালা আবু দাউদ এবং মুকাদ্দামায়ে মুসলিম মূল কাতাব ও ব্যখ্যা গ্রন্থের মাধ্যমে ভালোভাবে বুঝে পরিপূর্ণ অনুশীলন করতে হবে। শরহে মা’আনিল আসার, ইবনে মমাজাহ্, এবং মুয়াত্তাইনের লেখক ও কিতাব পরিচিতি আংশিকভাবে এবং প্রতিটি কিতাবের অন্তত শুরু অংশ থেকে খুব ভালোভাবে পড়া আবশ্যক।

লেখক: কলামিষ্ট, গবেষক, ইসলামিক চিন্তাবিদ ও মুহাদ্দিস ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা।

পরবর্তী পর্বে থাকছে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস্, তাই সয়্গে থাকার অনুরোধ।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments